Skip to main content

ধন্দ

একটা প্রশ্ন মাঝেমাঝেই একটা অদ্ভুত ধন্দে ফেলে দেয় ......
আমার জীবনের সবচেয়ে দুটো গুরুত্বপূর্ণ মানুষ সম্পুর্ণ দুটো আলাদা মেরুর৷ আমার মা এবং আমার কুমার বাহাদুর ৷ আমার মার ৩৩ কোটি দেব - দেবীর ওপর প্রবল আস্থা আর আমার কত্তা বাবু পুরোদস্তুর নাস্তিক৷ আমার বাবাও ঈশ্বর বিশ্বাস করতেন না কিন্তু আমার মা কে কোনকিছু থেকে বিরত কখনও করেননি ৷ পুজোর দশকর্মা, ফলের বাজার থেকে মিষ্টি আনা এবং পুজোর পর মহানন্দে প্রসাদ খাওয়া, এই সবই বাবা সইচ্ছাতেই করতেন৷ কুমার বাহাদুরের সঙ্গে, আমার যে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মাধ্যমে আলাপ, সে আমায় বলেছিল , ওরা নাস্তিক জানিস, ওদের বাড়ীতে কোন পুজো হয় না, নিয়ম মেনে বিয়েও হয় না, শুধু রেজিষ্ট্রি হয়৷ শুনে বলেছিলাম ভালোই তো, ঝামেলা কম৷
নিয়ম মাফিক ভালোবাসার প্রস্তাব দেওয়া - নেওয়া আমাদের মধ্যে কখনও হয়নি, কিন্তু যখন মনের দপ্তর ঘোষণা করল সম্পর্কটা শুধু বন্ধুত্বের থেকে আরও আরও বেশি কিছু, মনে আছে আমি ওকে বলেছিলাম, "আমি বাড়ীর একটিমাত্র মেয়ে, আমার বিয়ে নিয়ে অনেকের অনেক শখ আল্হাদ আছে, তোমাদের বাড়ীতে না হলেও, আমাদের বাড়ীতে কিন্তু নিয়ম মেনেই বিয়ে করতে হবে৷" ও এক কথায় হাসতে হাসতে বলেছিল, "তাই হবে চাপ নিও না৷" আমার শ্বশুরমশাই বলেছিলেন, "শ্রীরূপার কোন ইচ্ছে থাকলে সেটা যেন অপূর্ণ না থাকে৷" তাই হলও - আমার শাশুড়ি মা আমায় যত্ন করে তত্ত্ব, গায়ে হলুদ পাঠিয়েছিলেন একটা ব্যাগে আর সাথে মিষ্টির বাক্স৷ যদিও আমাদের বাড়ীতে আচার - নিয়মের খুব যে বাহুল্যতা ছিল তা নয়৷ দুরকম মতামতে বিশ্বাসী দুটো পরিবার হলেও, কোনরকম দ্বন্দ - বিবাদ ছাড়াই বিয়েটা মিটেছিল৷
এতো গেলো পরিবারের কথা, মা'র কথা, কুমারের কথা .... এরা সবাই জানে এরা কোথায় দাড়িয়ে৷ এদের বিশ্বাস, অবিশ্বাস ধারণা নিজের নিজের কাছে একেবারে পরিস্কার৷ আমার মা তার ঠাকুর - দেবতা নিয়ে দিব্যি আছে আর আমার বর তার বিজ্ঞান নিয়ে৷ কিন্তু সমস্যায় পড়েছি আমি ৷ আমি ঠিক কোথায় দাড়িয়ে, আমার বিশ্বাস কি?? আমি কি মানি ঈশ্বর? বিশ্বাস রাখি?? আমি নিজেই সেটা বুঝতে পারি না৷ ছোটবেলায় বেশ ঠাকুর ভক্ত ছিলাম৷ ঠাকুমার মতন রোজ সকালে চান করে তুলসি গাছে জল দিতাম, মা ঠিক যেভাবে ধুপ ঘুরিয়ে পুজো করত, সেই ভাবে ধুপ দিতাম, মাঝে মাঝে সন্ধেও দিয়ে দিতাম৷

ইউনিভারসিটির প্রথম বছরে যখন পড়ি , একজনের সাথে আলাপ হলো, মনে হলো এর থেকে বেশী ভালোবাসতে আর কাউকে পারব না৷ হঠাৎ কি মাথায় চাপল মা যেমন বাবার মঙ্গল চেয়ে সোমবারে শিবের মাথায় জল ঢালত, আমিও শুরু করলাম৷ নিজের ভক্তি দেখে নিজেই অবাক হয়ে যেতাম৷ এরকিছু মাস পরেই বাবা মারা গেলেন আর যাকে ভেবেছিলাম জীবন - দোসর সেও বাবার দশার দিন জানিয়ে দিল তার মনের মধ্যে আমার যে দাগটি ছিল, সেটা মিলিয়ে গেছে৷ দুটো মৃত্যু ...বাবার আর বিশ্বাসের .... পায়ের তলা থেকে জমিটা কেড়ে নিয়েছিল৷ মনে হল কিসের ঠাকুর, কিসের বিশ্বাস৷ কিছু বছর পর যখন একটু ধাতস্থ হয়েছিলাম, কোথাও একটু আত্মগ্লানি হয়েছিল৷ মনে হয়েছিল, বিনিময়ে পেলে তবেই ঈশ্বর বিশ্বাস, তাহলে কি বিশ্বাস এতই ঠুনকো! কই মায়ের বিশ্বাসেতো কোন ফাটল নেই৷ সেও জীবনের কম বড় মানুষকে হারায়নি৷ এতদিন বিশ্বাস করত ঠাকুর তার স্বামীকে সুস্থ করে দেবে, তিনি নেই, এখন তার বিশ্বাস তার মেয়ের জীবন তিনি ভরিয়ে দেবেন৷ এবং কুমার বাহাদুরের সাথে সম্পর্ক এবং বিয়ের পর সেই বিশ্বাস, গালা দিয়ে শীলমোহর আটার মতন বসে গেছে৷
এরপর আমার জীবনে এল কুমার কত্তা৷ সে আমায় কোনকিছুতেই বাধা দেয়না৷ শুধু যুক্তি দিয়ে সব কিছু ঝুঝিয়ে দেয়৷ আমায় বলে তুমি যদি মানো ঈশ্বর আছেন, আমায় প্রমাণ দাও, তুমি কেন বিশ্বাস করো ঈশ্বর আছেন আমায় বোঝাও, আমিও মানবো৷ আমি দু- একটা উদাহরণ দিলে তাকে যুক্তির ছাঁচে ঢেলে আমায় এমনভাবে বোঝাল যে আমিও সেই ঘটনাটার অন্য দিকটা যেন প্রথমবার দেখতে পেলাম, যুক্তিটা মনে থেকে গেল৷ আমায় দুটো কথা ও প্রায়ই বলে৷ প্রথমতঃ আমি যদি নিজের স্ত্রীকে ভুল ধারণার জাল থেকে বের করতে না পারি , আমার বিজ্ঞান পড়া বৃথা আর দ্বিতীয়তঃ নাস্তিকের কখনও জাত যায় না৷
আমি মানুষটা বরাবরই একটু নড়বড়ে৷ আমার আশপাশের মানুষের প্রভাবে প্রভাবিত৷ নিজের মত ... নিজের পথ যে কি .... তা নিজেই বুঝতে পারিনা৷ মাথা - মনের তাল , ছন্দ অনেক সময়ই মেলে না ৷ কোন বেপাকে পড়লেই একটা মন বলে ওঠে ভাবিস না ঠাকুর সব ঠিক করে দেবে অমনি অন্য মনটা বলে বসে, কে ঠাকুর? কিসের ঠাকুর? নিজের সমস্যা নিজে মেটাও, বেকার বুজরুকি ধরে বসে থাকা যাবে না৷ উফফ কি যে মুশকিল কি বলি !!!!!! আমার কত্তা বলবে, তুমি নাস্তিকই ... আস্তিক হলে এত সহজে আমার যুক্তিগুলো মানতে পারতে না ... আবার মা বলবে মনে মনে তুই কোথাও একটা বিশ্বাস রাখিস, তুই বুঝতে পারিস না৷ নিজেকে বুঝে উঠলে পারি না, আসলে আমি কি .... আমায় কেউ কখন বলেনি মানতেই হবে, আবার কেউ কখনও এটাও বলেনি মানবেই না ৷ কিন্তু আজ অব্দি আমি নিজেই বুঝে উঠতে পারলাম না.... আমি ঠিক কোথায় দাড়িয়ে....আমার মনের পাল্লাটা কোন যুক্তির পক্ষে মা'র বিশ্বাস নাকি কুমারের অবিশ্বাস ....
আমি কি নাস্তিক নাকি আস্তিক নাকি কুমার বাহাদুরের ভাষায় অজ্ঞেয়বাদী ????

Comments

Popular posts from this blog

একটা চেয়ার আর কিছু গল্পকথা

দোলনা চাপতে কার না ভালো লাগে....আমার তো ছোটবেলা থেকেই দোলনার প্রতি অমোঘ আকর্ষণ...কিন্তু মুশকিলটা ছিল মানুষটা আমি ছোট থেকেই বেশ মোটাসোটা, ফলত দোলনা চাপলেই আশপাশ থেকে কেউ না কেউ বলে উঠত "এইরে দোলনাটা ভেঙে পড়ল বলে" বা "দোলনাটা হাতিদের চড়ার জন্য নয়" আরও কত কি...খুব কষ্ট হত.... কষ্টে ঝপাং ঝাপ দিয়ে নেমে পড়তাম। তখন কলেজে পড়ি...আমার সবথেকে ভালো বন্ধুর বাড়ির উল্টো দিকে একটা পার্ক ছিল...প্রথম দিনই ওদের বাড়ি যাওয়ার সময় লক্ষ্য করেছিলাম ওই পার্কটিতে দুটো দোলনা আছে এবং যার সামনে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল "২-৫ বছরের শিশুদের জন্য" ... তাতে কি !!! প্রথম ভালোবাসার টানে মানুষ সব অন্যায় করতে পারে ... যেদিন ওদের বাড়ীতে রাত্তিরে থাকতাম ... ৬টার পর পার্ক বন্ধ হয়ে গেলে ... অন্ধকারে ছোট পাঁচিল টপকে আমরা পার্কে ঢুকতাম ... আর মনের আনন্দে আমি দোল খেতাম ... ভাবলাম কি ভালো ... কেউ কিছু বলার নেই বারণ করার নেই ... কোন সময় সীমা নেই যতখুশি যতক্ষণ খুশি দোল খাও। এইভাবে ২-৩ বার সাধ পুরণের পরই ... একদিন পার্কের পাশের বাড়ী থেকে চিৎকার শোনা গেল "কে?? কেএএএ? কারা পার্কে?? প্রায়ই পার্ক বন্ধ হব...

চিরসখা "সন্দেশ"

কাল সন্ধ্যেয় নানা রকম গপ্পের মধ্যে কথায় কথায় "সন্দেশ" এর কথা উঠলো। কুমার বাহাদুরের জীবনে দুরকম সন্দেশই কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা মোটামুটি ওর কাছের লোকজন সবাই জানে। এক সন্দেশে তার উদরতৃপ্তি ঘটে আরেক "সন্দেশ" তার মনের আরামের খোরাক। সেই ৯৫ সালে মেজপিসি "সন্দেশ" পত্রিকার গ্রাহক করে দিয়েছিলো। তারপর থেকেই কুমারের অন্তরতম সঙ্গী হয়ে ওঠে "সন্দেশ"। গত ২৫ বছরের সন্দেশের সব সংখ্যাই আছে বোধকরি ওর সংগ্রহে আছে। এখনো অন্যান্য যেকোনো পুজোসংখ্যার আগে "সন্দেশ" কবে বেড়োচ্ছে সে খবর জোগাড়ে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ থাকে। আমায় আগেও বলেছিলো, কাল যখন "সন্দেশ" এর কথা উঠলো, হঠাৎ মনে পড়ে গেলো। জিগালুম,  সন্দেশে তোমার একবার লেখা বেড়িয়েছিলো না??? হ্যাঁ, হাত পাকাবার আসরে। তোমার কাছে আছে সেই সংখ্যাগুলো?? থাকবে না কেন!! বের করোতো। এমনিতে তো ভুলোরাম, কোথায় কি রাখে দুমিনিট অন্তর ভুলে যায়, কিন্তু নিজের আজীবন দোসরদের খুঁজে পেতে তার বিন্দুমাত্র দেরী হয় না। বলতে না বলতে নিয়ে চলে এলো। ৪ টে গল্প বেড়িয়েছিলো, একটা গল্পের সাথে একটা ছবিও ছিল কিন্তু সেটা কোনো কা...

সারপ্রাইজের জন্মদিন

বছরের একটা দিন আছে যেটা শুধু আমার, যেদিন সবাই আমার কথা শুনবে , আমার সব আবদার , দাবী মানতে আমি বাধ্য করবো , সবাই ভালো - ভালো কথা বলবে , সেই দিনের আমিই রাজা ৷ সেটা বছরের একটাই দিন ,জন্মদিন ৷ এবছর ৩১ হলো , থুড়ি মা'র কথায় ৩০+ ৷ মা'তো পারলে বয়সটা তিনেই আটকে রাখে ৷ তো যা বলছিলুম , জন্মদিন ... প্রতি বছর আমি আমার জন্মদিন নিয়ে প্রবল উৎসাহিত থাকি, হ্যাঁ নিন্দুকের মুখে ছাই দিয়ে বলব এই ৩১ এও আমার জন্মদিন নিয়ে উৎসাহে কোন ঘাটতি নেই আর আগামী যতগুলো বছর বাঁচবো একই উৎসাহপ্রথা চলতে থাকবে এ কথা হলফ করে বলতে পারি ৷ আগষ্ট মাস পড়লেই আমার মনে হতে থাকে ১২ তারিখ আসছে আসছে , মা'কে মনে করানোর দরকার পড়ে না , তিনি তো আমার এক কাঠি ওপরে ৷কিন্তু আমার ভুলো বরটা যাতে কোনভাবেই না ভোলে তার প্রস্তুতি পুরোপুরি নিয়েনি ৷ না বাবা , বর জন্মদিন ভুলে যাবে , তারপর জন্মদিনের সারাদিন মুড অফ করে মান - অভিমান করব, ঐ সব চক্কোরে আমি নেই ৷ তাই সপ্তাখানেক আগে থেকেই কাউন্টডাউন চালাতে থাকি ৷ যদিও ওর জন্য ঐদিন ভোলা খুব একটা সহজ না , একই দিনে বউ আর মা'র জন্মদিন হলে , সেইদিনটি ভোলা একটু চাপের ৷ প্রতি বছর কুমার বাহাদুর ঘোর চ...