ছোটবেলা থেকেই আমার লম্বা ঘন চুল ছিল। খুব ভালো লাগতো আমার। মা মাঝে মধ্যে গজগজ করতো। তার কারণও ছিল অবশ্য। সকালে স্কুলে বেড়োতাম ৮.৩০ টায়। ভোর বেলা উঠে কাজ গুছিয়ে, রান্না করে, আমার টিফিন তৈরি করে তারপর বসতে হত মাকে আমার চুল বাঁধতে। স্কুলের নিয়ম ছিল বড় চুল মানেই দুটো বিনুনি বেঁধে যেতে হবে। প্রায়ই বলত,"উফ তোর চুল বাঁধতে আমার হাত ব্যথা হয়ে যায়, দেব ছোট করে এবার।" আমার সাপোর্টে সবসময় ছিল বড়মা। বলত চিন্তা করিস না; তোর মা অমন বলছে, আমি কাটতে দেবই না তোর চুল। আর তাছাড়া আমিও জানতাম মার ওসব কথার কথা। একটু বড় হতে মজা করে যদি বলতাম ভাবছি চুলটা কেটেই দেবো, ওমনি বড়বড় চোখ পাকিয়ে বলতো, "খবরদার, একদম নয়।"
সেই থেকে লম্বা ঘন একঢাল চুল। খুব ভালো লাগতো আমার। দেখতে শুনতে কোনদিনই তেমন ছিলাম না। কিন্তু আমার চুল দেখেই নিজেরই মন ভরে যেত। স্কুল থেকে ফিরলে সন্ধ্যে বেলায় মা কালো কার দিয়ে বেড়া বিনুনি বেঁধে দিত। কি যে অদ্ভুত দেখতে লাগতো তারপর কি বলবো। রাত্তির বেলায় চিত হয়ে শুতেই পারতুম না, ঘাড়ে ব্যথা হয়ে যেত, পাশ ফিরে শুতে হতো ।
বাবা মারা যাওয়ার পর, নিয়ম-কানুন মেটার ১৩ দিন পর যখন চুল আঁচড়ালাম প্রায় অর্ধেক চুল গেল উঠে । তারপরও যেটুকু ছিল, কালের প্রভাবে এবং অযত্ন, জল-বদল, দূষণ ও অ্যানিমিয়ার চক্করে সেটুকুও গেল।
চুলটার অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে গেছিলো যে দেখে নিজেরি কষ্ট হত। বহুদিন ধরেই ভাবছিলাম, ধুর কেটে ফেলি। পারছিলামই না। এত ভালোবাসার জিনিষ, সেই কোন ছোট্ট থেকে সঙ্গী। সাহস করেই উঠতে পারছিলাম না। নিজেই নিজেকে বোঝাতে পারছিলাম না। খুব সামান্য ছোট্ট একটা ব্যাপার, তবু।
যুক্তি খুজতাম এই ভেবে যে দুই মা'ই বলে শাড়ী পরে লম্বা চুল খুলে বেশ লাগে আমায়, তারা কি ভাববে। যদিও ভালোই জানতাম আমার কোনো ইচ্ছেতেই কোনদিনই বাঁধা দেয়নি আমার দুইবাড়ির কেউই। আসলে সেটা নয়, টানাপোড়েনটা নিজের মধ্যেই ছিল।
কিন্তু শেষমেশ কালকে সাহসটা করেই ফেললাম।একদম ঘ্যাচাং ফু...
এরম করলেই যা হয়, বাড়ি এসেই ছবি তুলে বন্ধুদের, দিদিদের পাঠাতেই হয় রেসপন্স পাওয়ার জন্য। তাই করতেই কেউ বলল ভালো হয়েছে, কেউ বলল ইশ ওতো সুন্দর চুল কেন কেটে ফেললি। কিন্তু সবাই একটা কথা অবশ্যই জানতে চাইলো যে বর কি বলল। এমনকি যে পার্লারে চুল কাটলাম সেই পার্লারের দিদিও বলল, বর কি বলল পরের দিন বলো কিন্তু। সবাইকে আর কি বলি, যে আমার কুমার বাহাদুর এমনি এক বিরল প্রজাতির বর যে আদৌ বুঝতেই পারবে না চুলের কি পরিবর্তন হয়েছে। এমনকি কোনোদিন যদি নেড়াও হয়ে গিয়ে বলি দেখ আমি নেড়া হয়েছি, বলবে ,"তাই! নেড়া হলে, খুব ভালো হয়েছে, আর চুল ঘেঁটে যাবে বলে হেলমেট পড়া নিয়ে ঝামেলা করবে না।"
৩২ বছরে এই প্রথম। অন্য কারুর জন্য নয়, নিজের জন্যই পারছিলাম না । আসলে নিজেকে অন্য ভাবে দেখতে অভ্যস্থ ছিলাম নাতো, তাই হয়ত অত দ্বন্ধ। ইকটু মনখারাপ হয়েছিল, কিন্ত ভালোই লাগছে, বেশ নতুন লাগছে নিজেকে। ইকটু ইকটু অন্যরকম।


Comments
Post a Comment