সকালের দিকে হাতে সময়টা কম থাকে৷ কুমার কলেজে বেরোবে, আমি স্কুলে৷ সচারাচর সকালের কাজকম্মো আমরা দুজনে মিলে ভাগাভাগি করেই করি৷ রান্না, বাজার, টিফিন গোছানো, সবাইকে জলখাবার দিয়ে দুপুরের খাবার গুছিয়ে রাখা আমার দপ্তেরর দায়িত্ব আর বিছানা তোলা, জামাকাপড় কাচা, বোতলে জল ভরার দায়িত্বে কুমার বাহাদুর৷ কিন্তু গত দু - তিন দিন কুমার আমার জ্বরে এক্কেবারে কাবু, ফলত সব কাজ এবং তার দেখভালে সকালের ব্যস্ততা আরও বেড়ে গেছে৷
গতকাল সকালে চটপট স্নান সেরে গেছি ওপরের বারান্দায় জামাকাপড় মেলতে৷ ওপরের লম্বাআআ বারান্দায় জামাকাপড় মেলার জন্য তারের দড়ি টাঙানো, দড়ির মধ্যে সরু সুতো দিয়ে বাধা ক্লিপ ঝোলানো থাকে ৷ চটপট মেলছি, একটা জায়গায় এসে দেখি, আর ক্লিপ নেই ... ভাবলাম যাহ্ বাবা এতগুলো ক্লিপ ছিল গেল কোথায়! ওমা তাকিয়ে দেখি ৪-৫ টা ক্লিপের সুতো একে অপরের সাথে জড়িয়ে, তারা তার দড়ির এক প্রান্তে ঝুলে রয়েছে৷ দেখেই মাথাটা একটু গরম হলো ভাবলাম, "উফ, একে কাজের শেষ নেই আবার এই ঝামেলা৷ ধুর এমনি মেলে দিই, ক্লিপ আটকাবো না৷" এই ভেবে জামাকাপড় গুলো মেলে রান্নাঘরের দিকে যেতে যাব, কি মনে হলো দাঁড়িয়ে গেলাম৷ ভাবলাম কাচা জামাকাপড় গুলো উড়ে রাস্তায় পড়লে আবার কাজ বাড়বে৷ একটু বিরক্তভাবেই ক্লিপ সুতোর জট ছাড়াতে জুটলাম৷ বাপরে বাপ, কি জটটাই না পেকেছে, একদিক খুলি তো আরেক দিক আটকায়, আরেকদিক হালকা করি তো অন্যদিকের গেঁট চেপে বসে; জোরজার করতে গেলে আরও এটে যায়, একবার মনে হলো দিই কাঁচি দিয়ে কেটে,ঝামেলা যাবে চুকে; তারপর মনে হলো কেটে দিলেই তো নষ্ট হয়ে যাবে, আরএকটু ধ্যৈর্য দিয়ে চেষ্টা করে দেখিই না ...
সুতোর জোট ছাড়াতে ছাড়াতেই হঠাৎ মনে হলোঃ জীবনের, মনের, সর্ম্পকের জোটগুলোও তো খানিক এরকমই৷ ভাবি এখন এসব নিয়ে ভাববো না, সময় নেই আর কিইবা হবে ভেবে, এমনি সব ঠিক হয়ে যাবে৷ কিন্তু তা কি সত্যিই হয়!! হয়না ... উল্টে নিজেদেরই ঝামেলা বাড়ে, কষ্ট বাড়ে৷ মাথার মধ্যে সবসময় ঐ একই গিঁট, কিট কিট করে৷ জোর করে চেপে দিলে, আরও গিঁট্টু পাকিয়ে যায়৷ কেটে ফেলা তো যেতেই পারে কিন্তু সেটাও কষ্টকর ... তার থেকে একটু সময় নিয়ে গেঁটের ফাঁসকে আলগা করলে এক একটা মান, অভিমান, কষ্ট, ভুল বোঝাবুঝি, খারাপ লাগা গুলো যখন বেরিয়ে পড়ে, সব জোট খুলে মন হাল্কা হয়ে যায়৷ ফুরফুরে নিশ্চিন্তিতে ভরা মনটা এক্কেবারে মিষ্টি মিষ্টি হয়ে যায়৷
দেখেছো কান্ড ... এত্ত কাজ পড়ে ... এই হোল এক মুশকিল ... কিছু না কিছু কথা - ভাবনা মাথার মধ্যে সুড়সুড়ি দিলেই ঘড়ি - ঘন্টার খেয়াল থাকেনা আমার ... কুমার মাঝে মাঝে ঋত্বিক ঘটকের বুলি আওরিয়ে, বলেঃ "ভাবো, ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো"৷ আমি বলি আমার আর প্র্যাকটিস করে কাম নাই, এমনিতেই এই ... আবার প্র্যাকটিস করলে না জানি কি হাল হবে ...
যাইহোক ক্লিপ সুতোর জট ছাড়াতে বেশী সময় লাগলো না।
আলতো হাতে আস্তে আস্তে একটা একটা সুতোর পাক ছাড়াতেই, জট গেল খুলে৷ আমিও নিশ্চিন্তে জামাকাপড়ে ক্লিপ আটকে নিজের কর্মব্যস্ততায় গেলাম ডুবে৷
Comments
Post a Comment