গতবছর উড়িষ্যা ট্রিপে বসেই ঠিক হয়েছিল এবছরের ডেস্টিনেশন ডুয়ার্স। প্রস্তাবটা অনির্বানই দিয়েছিলো। চল এবার ডুয়ার্স যাই, বক্সা-লেপচাখা-জয়ন্তী আর ফেরার পথে কোনো একটা জঙ্গল। প্রস্তুতি শুরু হলো সেই মতন। প্রতিবারই যা হয় - কটা টিকিট কাটা হবে সেই নিয়ে টানাপোড়েন। এই চার মাস আগে টিকিট কাটার গপ্পোটা বড্ড ঝামেলার। তাই মোটামুটি গড়ে হিসেব করে ৯ টা টিকিট কাটা হলো। উত্তরবঙ্গে যাওয়া পাকা ।টিকিট কাটার ঝঞ্ঝাট নিয়ে আমি গপ্পো ফেঁদে বসলাম। (দ্রঃ টিকিটপুরাণ) ফেরার টিকিটের দিনই হলো ঝামেলা। কাঞ্চনকন্যায় ওয়েটিং হয়ে গেলো। কুমার কত্তার সব কাজ একদম যথাযথ হওয়া চাই, তাই কনফার্ম হয়ে যাবে এই আশা রেখেও পরের দিনে কাঞ্চনজঙ্ঘায় কনফার্ম টিকিট কেটে রাখলো। মাসবদলের সাথে সাথে আমাদের যাওয়ার সদস্য সংখ্যাও পাল্টাতে থাকে। কখনো ৯ থেকে ৭ কখনো বা ৫ আবার কখনো ৬। দীপঙ্কর দা মানে যিনি আমাদের ডুয়ার্সের দিনযাপনের ব্যবস্থাপনার সম্পূর্ন দায়িত্বে ছিলেন তারও মাথা খেতে থাকি। কখনও বলি ৯ জন যাচ্ছি না ৭ জন, কখনও বলি ৫ জন কনফার্মই কনফার্ম; আবার যাওয়ার একমাস আগে বলি, একটু ম্যানেজ করে ৮ জনের ব্যবস্থা করে দাও। কিভাবে যে উনি সবটা অ্যারেঞ্জ করেছিলেন সত্যি জানিনা। যার উদ্যোগে সবটা শুরু হয়েছিলো সেই অনির্বান বাঁধিয়ে বসলো ডেঙ্গু। মনটা বড্ড খারাপ হয়ে গেল। অনিকে ছাড়া পাহাড়ে ঘোরা ভাবাই যায় না। মেঘলা মনে মেঘের জগতে পারি দিলুম আমরা ৮ জনে।
উত্তরবঙ্গ ধরে পৌঁছলাম নিউ কোচবিহারে। রিটারিং রুমে প্রয়োজনীয় প্রাত্যহিক কাজকর্ম মিটিয়ে একদম ঝরঝরে হয়ে বেড়িয়ে এসে খোঁজ লাগলাম গাড়ির। দীপঙ্কর দা সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল। গাড়ির ড্রাইভার অসীম ভাই তখন গাড়ির মাথায় সবে লাগেজ বাঁধছে, কোথা থেকে এক মাতাল অটো ওলা এসে হট্টগোল বাঁধালো। টলতে টলতে তার ডিকশনারিতে থাকা যাবতীয় গালাগাল সে আমাদের ড্রাইভারের উদ্দেশ্য নিবেদন করে যেতে থাকলো একের পর এক। কুমারের সবেতেই খিল্লি করার অভ্যেস, সে এগিয়ে বলে, "তোমার একটা ছবি তুলি হ্যাঁ?" যেই না বলা দিব্বি সে পোজ দিতে শুরু করে, কিন্তু ছবি তোলা হতেই সে তার ফটগ্রাফারের উদ্দেশ্যে অ ব ক চ র লাইন লাগিয়ে দেয় এবং বলতে থাকে, "হ্যাঁ হ্যাঁ ফেসবুকের দিবে আর বলবে এই লোকটা গালি দেয়, তাই না?" বলে আবার গালির ফুলঝুরি দিতে দিতে তেড়ে আসে কুমারের ফোন কাড়তে। এই একখান ঝামেলা লেগে যায় আর কি। কোনো রকমে তাকে হটিয়ে ঝপাঝপ গাড়িতে উঠে বসলাম, ওখানকার লোকাল কিছু লোকজন এসেও তাকে পাশে সরিয়ে আমাদের যাওয়ার রাস্তা করে দেয়। এত মধুর বাক্যবাণ বোধকরি আর কেউ কখন কুমারকে শোনাতে পারবে না।
যাইহোক, সকালটা এমন খিল্লি দিয়ে শুরু হলে খিল্লির পারা এমনিতেই চড়ে যায়। গপ্পো, আড্ডা, খিল্লি বেজায় জমে উঠেছে,গাড়িও ছুটছে, কিন্তু পেটে এদিকে ছুঁচোরা রীতিমতন প্রতিযোগিতা লাগিয়ে দিয়েছে। তাদেরকেই শান্ত করতে অসীম ভাইকে বললাম ভালো দেখে একটা খাওয়ার জায়গায় দাঁড় করাতে। সে নিয়ে গিয়ে থামালো ছোট ছোট দুটো দোকানের সামনে। প্রথমটাতে ঢুকতেই তারা বলল সবে দোকান খুলেছে, কোনো খাবারই পাওয়া যাবে না। পাশের টায় হানা দিলুম, তারা অভয় দিলো খাবার-দাবার পাওয়া যাবে, কিন্ত একটু সময় দিতে হবে। ঝপাঝপ করে চরম উৎসাহে ভদ্রলোক আটা মেখে রুটি বানাতে শুরু করে দিলেন। তার সাকরেদ বাটিতে বাটিতে তরকারি সাজাতে লাগলো। সয়াবিনের তরকারি, আলুবেগুনের তরকারি, ডিমের কারি। আমরা তারওপর অর্ডার করলুম ওমলেট। ভদ্রলোক রুটি বানাচ্ছেন বানাচ্ছেন, আমাদের পেটের ছুঁচো গুলো তিনগুন বেগে রেস লাগাচ্ছে। শেষে থাকতে না পেরে বললুম একটা একটা করেই সবাইকে দিন আগে তারপর নয় আরো দেবেন। যাইহোক রুটি আসতে থাকলো আমাদের মুখও চলতে থাকলো। আবার আটা মাখলেন ভদ্রলোক আবার গরম গরম রুটি। পরম তৃপ্তিতে পেট মন ভরিয়ে যখন ওনাকে জিগেস করলাম কত হলো??? হাত নেড়ে বললেন অত হিসেব নেই, আপনারাই হিসেব করে যা দেয়ার দিন। এই মানুষগুলোকে দেখলে সত্যি মনে হয়, এরকমও বেহিসেবী ব্যবসাদার হয়!!!
গাড়ি ছুটে চলল বক্সা টাইগার রিজার্ভের সাঁওতালবাড়ি জিরো পয়েন্টের উদ্দেশ্যে। টাইগার রিজার্ভে ঢোকার মুখে পারমিট করাতে হয়, মাথা পিছু ১০০ আর গাড়ির জন্য ৩০০। অনুমতিপত্র নিয়ে , জিরো পয়েন্টের খানিকআগেই গাড়ি থামলো একটা তেমাথায়। একজন লোক বড় ছাতা খাটিয়ে একটা ভাঙা টুল আর নড়বড়ে টেবিল নিয়ে বসে রয়েছে দেখলুম, আর তার আসে পাশে ১০-১২ জন এই ১২-১৪ বয়সী ছেলেপুলের ভীড়। অসীম এসে বলল এখান থেকে গাইড নিতে হবে। অংশুমান আর কুমার কত্তা গেলো লেখাজোকার কাজ সারতে, আমরা গেলুম মোমো খেতে। মোমো খেয়ে বাড়িতে ফোন করে দিলুম, পাহাড়ে উঠছি, সামনের দুদিন নো কন্টাক্ট।
কুমার আর অংশু একবার ইশারায় জিগেস করলো পোর্টার লাগবে কিনা, আমি আর শুক্লা একটু টানাপোড়েনে ছিলুম যে ব্যাগ নিয়ে উঠতে পারবো কিনা, বোবো মানে আমাদের বব বলল নো চাপ তোমাদের ব্যাগ আমি বয়ে দেব। আমাদেরও ইগো, সঙ্গে সঙ্গে বললুম না আমাদের ব্যাগ আমরাই বইবো, নো পোর্টার। অসীম ভাই বলল গাড়ী আরো খানিকটা যাবে। তারপর আপনাদের হেঁটে উঠতে হবে। ওই যে গাইড আসছে। গাইডকে দেখে চোখ ছানাবড়া। পুচকে একটা ছেলে নাম নাসিব লেপচা। ক্লাস ৮ এ পড়ে। এখন ছুটি চলছে তাই এই কাজ করছে। এই করেই পড়াশোনা চালায়। ভীষণ ভালো মিষ্টি একটা ছেলে। দিনযাপনের কঠিন কর্কশ লড়াই দিব্বি প্রাণোচ্ছল ভাবে হেসে কাটিয়ে দেয়।
গাড়ি পৌঁছে গেলো জিরো পয়েন্টে। আপন আপন বোঝা নিয়ে শুরু হলো আমাদের পথ চলা। আমরা অনভিজ্ঞ ট্রেকার্স। এর আগের অভিজ্ঞাতা বলতে হিলে থেকে ভার্সে। (দ্রঃ পাহাড়ের ডায়েরি) আমাদের পণ নো তাড়াহুড়ো, ধীরে ধীরে আসতে আসতে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে লক্ষ্যে পৌঁছনো। আমায় আর শুক্লাকে একখানা করে লাঠি এনে দিলো নাসিব। আসতে আসতে উঠতে থাকলুম।
এদিকে আরেক বিপত্তি। অঞ্জন তার সাধের টুপিটা ফেলে এসেছে সাঁওতালবাড়ির সেই মোমোর দোকানে। ব্যাপারটা টের পেতেই সে তড়বড়িয়ে আবার নীচে নামল টুপি উদ্ধার করতে। সে টুপি ইতিমধ্যে একজন নিজের মনে করে মাথায় চাপিয়ে নিয়ে কেত মারতে ব্যস্ত। শেষে মোমোর দোকানের মালকিনের সহায়তায় টুপি উদ্ধার করা গেল। টুপি উদ্ধার করে অঞ্জন যখন বুক চিতিয়ে ওপরে উঠেছে ততক্ষণে নাসিব তার ব্যাগটা পিঠে নিয়ে দৌড় দিয়েছে। ওরা পাহাড়ের ছেলে, একটা ব্যাগ নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে পাহাড়ে ওঠা ওদের কাছে জলভাত। তবু ঐটুকু বাচ্ছা ছেলের ঘাড়ে বোঝা চাপানোর ইচ্ছে আমাদের কারোরই ছিল না। অঞ্জন জোর করে তার ব্যাগটা কেড়ে নেওয়াতে নাসিবের নজর পড়ল কুমারের সাইড ব্যাগটার দিকে। যেই না ব্যাগটা নামিয়ে রেখে কুমার ছবি তুলতে গেছে ওমনি সেটা বগলদাবা করে দে দৌড়।
প্রকৃতি পরোতে পরোতে কত রূপ লুকিয়ে রাখে পাহাড়ে না উঠলে বোঝাই যায় না। এক একটা মোড় বেঁকছি, প্রত্যেকটা পাকে প্রকৃতি যেন নিজের এক অদ্ভুত অসামান্য রূপের হাট খুলে নতুন ভাবে ধরা দিচ্ছে। মনে হচ্ছে কি অসাধারণ আরো খানিকটা ওঠার পর মনে হচ্ছে এখানটা আরো অপূর্ব, আরো খানিক যাওয়ার পর মনে হচ্ছে এর চেয়ে ভালো কিছু হতেই পারেনা। কোনটা, কতটা যে ক্যামেরাবন্দি করবো দিশা খুঁজে পাচ্ছি না। পাহাড়, সবুজে সবুজে ঘীরে থাকা নানা রকম গাছ, দূরে বয়ে যাওয়া নদী আর প্রজাপতি। নানা রকমের প্রজাপতি। তারা অবশ্য ভীষণই ব্যস্ত। আমাদের পাশ দেওয়ার ও সময় নেই তাদের। তাধিং তাধিং করে নেচে নেচে উড়েই চলেছে। (দ্রঃ বক্সা পাহাড়ের প্রজাপতি) আমরা হাটছি, বসছি আবার হাটছি। অঞ্জন,বব, পল্লব, অংশুমান তরতর করে এগোচ্ছে, কোথাও দাঁড়াচ্ছে, আমরা এগোচ্ছি গুটি গুটি পায়ে। একে অন্যকে বুস্ট আপ করছি এবং আমরা নিশ্চিত হচ্ছি এই ভাবে আমরা একদিন এভারেস্টেও চড়ে যেতে পারবো। এইভাবেই ইয়ার্কি, গপ্পো, ছবি তুলতে তুলতে প্রকৃতির হাত ধরে, প্রকৃতির টানে নাসিবকে অনুসরণ করে গিয়ে পৌঁছলাম বক্সা গ্রামে আমাদের মাথা গোঁজা র ঠাঁইয়ে।
যখন পৌঁছলাম কারেন্ট ছিল না। আবছা অন্ধকারে পায়ে ঠেকলো কাঠের সিঁড়ি, কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠে বেশ বড় সর কাঠের দালান। সবাই হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়লুম। কি অদ্ভুত অনুভূতি ঠিক বলে উঠতে পারবো না। চাঁদনী রাত, জোৎস্না এসে পড়েছে কাঠের বারান্দায়, এতটা উঠে আসতে পেরেছি বলে অসম্ভব আত্মতৃপ্তি, ঘন্টি পোকা ডেকে চলেছে, এক অজানা অচেনা পাহাড়ি গ্রামে আমরা ৮ বন্ধু।
খানিক পরেই কারেন্ট এলো। আমাদের হোস্ট এখানে সুরাজ বলে একটি ছেলে। এই আমাদের পরের দিন লেপচাখা নিয়ে যাবে। প্রবল হাঁটাহাঁটিতে সবারই খিদে পেয়েছিলো। সোনাম দি গরম গরম ডিম ম্যাগী বানিয়ে দিলো খেয়ে দেয়ে আমরা গেলুম একটু ফ্রেশ হতে আর বেশ ঠান্ডা লাগতে আরম্ভ করেছে, তাই গরম জামাকাপড় বের করতে।
সবাই চেঞ্জ করে গরম জামাকাপড় জড়িয়ে এসে বসলাম কাঠের বারান্দায়। সুরাজের কাছে আবদার করলুম চা পকোরার। চলে এলো গরম গরম চা পাকোড়া। তারপর শুরু হলো গানের লড়াই। দুই দল একদলে অঞ্জন,পল্লব, বব, অংশুমান আরেকদলে আমি কুমার শুক্লা আর তন্ময়। জমজমাট হয়ে উঠলো আমাদের গানের আসর, খোলা পরিবেশে মনের আনন্দে গলা ছেড়ে আমরা গাইতে লাগলাম। ফোনে টাওয়ার নেই, কোনো কাজ নেই, কোনো দায়িত্ব নেই, সময়ের সঙ্গে তাল মেলানোর কোনো তাগিদ নেই ,কোনো তাড়া নেই। অনাবিল আনন্দের একমুঠো মুহূর্ত।
ডাক পড়লো রাতের খাওয়ার, কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নেমে পাশের ঘরে গিয়ে রাতের খাওয়া দাওয়া সারলাম। নাঃ আর বারান্দায় বসে আড্ডা মারা যাবে না ঠান্ডাটা বেশ বেড়েছে। আমাদের দুটো ঘর। একটা ঘরে গুটিসুটি মেরে বসলুম সব। শুরু হলো ভূতের গপ্পো। চারিদিক নিঃস্তব্ধ। প্রথমে অঞ্জন, তারপর পল্লবের ভূতের গপ্পে একেবারে জমে ক্ষীর আমাদের পাহাড়ী প্রথম নিশি। খেয়াল হলো ঘড়ি ১.৩০ পার করে দিয়েছে। ঘুমোনোর কারো কোনো ইচ্ছেই নেই। কিন্তু শুতেই হবে, কারণ কাল সকালে আবার বেড়োনো। তাই আর দেরি না করে গপ্পের ঝাঁপি পরের দিনের জন্য তুলে রেখে ঘুমোতে গেলাম।
পরের দিন খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো আমার। সবাই ঘুমোচ্ছে। ঘর থেকে বেড়িয়ে কাঠের সিঁড়িটা ভেঙে নেমে এলাম। সূর্য সবে উঠছে, যেদিকে তাকাই শুধু সবুজ আর সবুজ। আরো খানিকটা এগিয়ে গেলাম। প্রানভরে নিঃস্বাস নিতেই সবুজ বুনো গন্ধে প্রানটা ভরে গেলো। শুধু আমি আর প্রকৃতি, আর কেউ না।সময় এখানেই থমকে থাকুক। কিন্তু তা হবার নয়।
আমরা যেখানে ছিলাম তার সামনেই বক্সা ফোর্ট। সকালের সেই কাঠের বারান্দায় রোদ পোয়াতে পোয়াতে ল্যাদ খেতে খেতে আমরা জলখাবার সেরে আবার হাঁটাহাঁটির জন্য তৈরি হয়ে গেলুম। বক্সা ফোর্টেও একবার হানা দিলুম। বক্সাফোর্ট ঘুরে বক্সফোর্টের সামনেই থাকা একটা গুমটি থেকে অসাধারণ স্কোয়াসের মোমো খেয়ে পাড়ি দিলুম লেপচাখায় উদ্দেশ্যে।
...
কবিতা লেখা আমার কম্ম নয়। ওটি ঝেঁপেছি অঞ্জনের দেয়াল থেকে।
ডুয়ার্স সফরনামাঃ স্মৃতিসুধায়
ডুয়ার্স সফরনামাঃ পাহাড় থেকে নদী, নদী থেকে পাহাড়
কোলাকুলি আর মিষ্টিমুখ রইল এখন তোলাআড্ডাঠেক এর বন্ধুরা বেরোল গুছিয়ে ঝোলা।শাল-শিমূলের ওম ছড়ানো, মেঘের চাদর মাখাদু'হাত নেড়ে হাতছানি দেয় বক্সা, লেপচাখা।স্মৃতির পারদ উঠবে চরে, তেরো নদীর পারে,ফিরব যখন, আমার শহর, গল্প শোনাস মোরে।
উত্তরবঙ্গ ধরে পৌঁছলাম নিউ কোচবিহারে। রিটারিং রুমে প্রয়োজনীয় প্রাত্যহিক কাজকর্ম মিটিয়ে একদম ঝরঝরে হয়ে বেড়িয়ে এসে খোঁজ লাগলাম গাড়ির। দীপঙ্কর দা সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল। গাড়ির ড্রাইভার অসীম ভাই তখন গাড়ির মাথায় সবে লাগেজ বাঁধছে, কোথা থেকে এক মাতাল অটো ওলা এসে হট্টগোল বাঁধালো। টলতে টলতে তার ডিকশনারিতে থাকা যাবতীয় গালাগাল সে আমাদের ড্রাইভারের উদ্দেশ্য নিবেদন করে যেতে থাকলো একের পর এক। কুমারের সবেতেই খিল্লি করার অভ্যেস, সে এগিয়ে বলে, "তোমার একটা ছবি তুলি হ্যাঁ?" যেই না বলা দিব্বি সে পোজ দিতে শুরু করে, কিন্তু ছবি তোলা হতেই সে তার ফটগ্রাফারের উদ্দেশ্যে অ ব ক চ র লাইন লাগিয়ে দেয় এবং বলতে থাকে, "হ্যাঁ হ্যাঁ ফেসবুকের দিবে আর বলবে এই লোকটা গালি দেয়, তাই না?" বলে আবার গালির ফুলঝুরি দিতে দিতে তেড়ে আসে কুমারের ফোন কাড়তে। এই একখান ঝামেলা লেগে যায় আর কি। কোনো রকমে তাকে হটিয়ে ঝপাঝপ গাড়িতে উঠে বসলাম, ওখানকার লোকাল কিছু লোকজন এসেও তাকে পাশে সরিয়ে আমাদের যাওয়ার রাস্তা করে দেয়। এত মধুর বাক্যবাণ বোধকরি আর কেউ কখন কুমারকে শোনাতে পারবে না।
যাইহোক, সকালটা এমন খিল্লি দিয়ে শুরু হলে খিল্লির পারা এমনিতেই চড়ে যায়। গপ্পো, আড্ডা, খিল্লি বেজায় জমে উঠেছে,গাড়িও ছুটছে, কিন্তু পেটে এদিকে ছুঁচোরা রীতিমতন প্রতিযোগিতা লাগিয়ে দিয়েছে। তাদেরকেই শান্ত করতে অসীম ভাইকে বললাম ভালো দেখে একটা খাওয়ার জায়গায় দাঁড় করাতে। সে নিয়ে গিয়ে থামালো ছোট ছোট দুটো দোকানের সামনে। প্রথমটাতে ঢুকতেই তারা বলল সবে দোকান খুলেছে, কোনো খাবারই পাওয়া যাবে না। পাশের টায় হানা দিলুম, তারা অভয় দিলো খাবার-দাবার পাওয়া যাবে, কিন্ত একটু সময় দিতে হবে। ঝপাঝপ করে চরম উৎসাহে ভদ্রলোক আটা মেখে রুটি বানাতে শুরু করে দিলেন। তার সাকরেদ বাটিতে বাটিতে তরকারি সাজাতে লাগলো। সয়াবিনের তরকারি, আলুবেগুনের তরকারি, ডিমের কারি। আমরা তারওপর অর্ডার করলুম ওমলেট। ভদ্রলোক রুটি বানাচ্ছেন বানাচ্ছেন, আমাদের পেটের ছুঁচো গুলো তিনগুন বেগে রেস লাগাচ্ছে। শেষে থাকতে না পেরে বললুম একটা একটা করেই সবাইকে দিন আগে তারপর নয় আরো দেবেন। যাইহোক রুটি আসতে থাকলো আমাদের মুখও চলতে থাকলো। আবার আটা মাখলেন ভদ্রলোক আবার গরম গরম রুটি। পরম তৃপ্তিতে পেট মন ভরিয়ে যখন ওনাকে জিগেস করলাম কত হলো??? হাত নেড়ে বললেন অত হিসেব নেই, আপনারাই হিসেব করে যা দেয়ার দিন। এই মানুষগুলোকে দেখলে সত্যি মনে হয়, এরকমও বেহিসেবী ব্যবসাদার হয়!!!
গাড়ি ছুটে চলল বক্সা টাইগার রিজার্ভের সাঁওতালবাড়ি জিরো পয়েন্টের উদ্দেশ্যে। টাইগার রিজার্ভে ঢোকার মুখে পারমিট করাতে হয়, মাথা পিছু ১০০ আর গাড়ির জন্য ৩০০। অনুমতিপত্র নিয়ে , জিরো পয়েন্টের খানিকআগেই গাড়ি থামলো একটা তেমাথায়। একজন লোক বড় ছাতা খাটিয়ে একটা ভাঙা টুল আর নড়বড়ে টেবিল নিয়ে বসে রয়েছে দেখলুম, আর তার আসে পাশে ১০-১২ জন এই ১২-১৪ বয়সী ছেলেপুলের ভীড়। অসীম এসে বলল এখান থেকে গাইড নিতে হবে। অংশুমান আর কুমার কত্তা গেলো লেখাজোকার কাজ সারতে, আমরা গেলুম মোমো খেতে। মোমো খেয়ে বাড়িতে ফোন করে দিলুম, পাহাড়ে উঠছি, সামনের দুদিন নো কন্টাক্ট।
গাড়ি পৌঁছে গেলো জিরো পয়েন্টে। আপন আপন বোঝা নিয়ে শুরু হলো আমাদের পথ চলা। আমরা অনভিজ্ঞ ট্রেকার্স। এর আগের অভিজ্ঞাতা বলতে হিলে থেকে ভার্সে। (দ্রঃ পাহাড়ের ডায়েরি) আমাদের পণ নো তাড়াহুড়ো, ধীরে ধীরে আসতে আসতে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে লক্ষ্যে পৌঁছনো। আমায় আর শুক্লাকে একখানা করে লাঠি এনে দিলো নাসিব। আসতে আসতে উঠতে থাকলুম।
এদিকে আরেক বিপত্তি। অঞ্জন তার সাধের টুপিটা ফেলে এসেছে সাঁওতালবাড়ির সেই মোমোর দোকানে। ব্যাপারটা টের পেতেই সে তড়বড়িয়ে আবার নীচে নামল টুপি উদ্ধার করতে। সে টুপি ইতিমধ্যে একজন নিজের মনে করে মাথায় চাপিয়ে নিয়ে কেত মারতে ব্যস্ত। শেষে মোমোর দোকানের মালকিনের সহায়তায় টুপি উদ্ধার করা গেল। টুপি উদ্ধার করে অঞ্জন যখন বুক চিতিয়ে ওপরে উঠেছে ততক্ষণে নাসিব তার ব্যাগটা পিঠে নিয়ে দৌড় দিয়েছে। ওরা পাহাড়ের ছেলে, একটা ব্যাগ নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে পাহাড়ে ওঠা ওদের কাছে জলভাত। তবু ঐটুকু বাচ্ছা ছেলের ঘাড়ে বোঝা চাপানোর ইচ্ছে আমাদের কারোরই ছিল না। অঞ্জন জোর করে তার ব্যাগটা কেড়ে নেওয়াতে নাসিবের নজর পড়ল কুমারের সাইড ব্যাগটার দিকে। যেই না ব্যাগটা নামিয়ে রেখে কুমার ছবি তুলতে গেছে ওমনি সেটা বগলদাবা করে দে দৌড়।
প্রকৃতি পরোতে পরোতে কত রূপ লুকিয়ে রাখে পাহাড়ে না উঠলে বোঝাই যায় না। এক একটা মোড় বেঁকছি, প্রত্যেকটা পাকে প্রকৃতি যেন নিজের এক অদ্ভুত অসামান্য রূপের হাট খুলে নতুন ভাবে ধরা দিচ্ছে। মনে হচ্ছে কি অসাধারণ আরো খানিকটা ওঠার পর মনে হচ্ছে এখানটা আরো অপূর্ব, আরো খানিক যাওয়ার পর মনে হচ্ছে এর চেয়ে ভালো কিছু হতেই পারেনা। কোনটা, কতটা যে ক্যামেরাবন্দি করবো দিশা খুঁজে পাচ্ছি না। পাহাড়, সবুজে সবুজে ঘীরে থাকা নানা রকম গাছ, দূরে বয়ে যাওয়া নদী আর প্রজাপতি। নানা রকমের প্রজাপতি। তারা অবশ্য ভীষণই ব্যস্ত। আমাদের পাশ দেওয়ার ও সময় নেই তাদের। তাধিং তাধিং করে নেচে নেচে উড়েই চলেছে। (দ্রঃ বক্সা পাহাড়ের প্রজাপতি) আমরা হাটছি, বসছি আবার হাটছি। অঞ্জন,বব, পল্লব, অংশুমান তরতর করে এগোচ্ছে, কোথাও দাঁড়াচ্ছে, আমরা এগোচ্ছি গুটি গুটি পায়ে। একে অন্যকে বুস্ট আপ করছি এবং আমরা নিশ্চিত হচ্ছি এই ভাবে আমরা একদিন এভারেস্টেও চড়ে যেতে পারবো। এইভাবেই ইয়ার্কি, গপ্পো, ছবি তুলতে তুলতে প্রকৃতির হাত ধরে, প্রকৃতির টানে নাসিবকে অনুসরণ করে গিয়ে পৌঁছলাম বক্সা গ্রামে আমাদের মাথা গোঁজা র ঠাঁইয়ে।
যখন পৌঁছলাম কারেন্ট ছিল না। আবছা অন্ধকারে পায়ে ঠেকলো কাঠের সিঁড়ি, কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠে বেশ বড় সর কাঠের দালান। সবাই হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়লুম। কি অদ্ভুত অনুভূতি ঠিক বলে উঠতে পারবো না। চাঁদনী রাত, জোৎস্না এসে পড়েছে কাঠের বারান্দায়, এতটা উঠে আসতে পেরেছি বলে অসম্ভব আত্মতৃপ্তি, ঘন্টি পোকা ডেকে চলেছে, এক অজানা অচেনা পাহাড়ি গ্রামে আমরা ৮ বন্ধু।
খানিক পরেই কারেন্ট এলো। আমাদের হোস্ট এখানে সুরাজ বলে একটি ছেলে। এই আমাদের পরের দিন লেপচাখা নিয়ে যাবে। প্রবল হাঁটাহাঁটিতে সবারই খিদে পেয়েছিলো। সোনাম দি গরম গরম ডিম ম্যাগী বানিয়ে দিলো খেয়ে দেয়ে আমরা গেলুম একটু ফ্রেশ হতে আর বেশ ঠান্ডা লাগতে আরম্ভ করেছে, তাই গরম জামাকাপড় বের করতে।
সবাই চেঞ্জ করে গরম জামাকাপড় জড়িয়ে এসে বসলাম কাঠের বারান্দায়। সুরাজের কাছে আবদার করলুম চা পকোরার। চলে এলো গরম গরম চা পাকোড়া। তারপর শুরু হলো গানের লড়াই। দুই দল একদলে অঞ্জন,পল্লব, বব, অংশুমান আরেকদলে আমি কুমার শুক্লা আর তন্ময়। জমজমাট হয়ে উঠলো আমাদের গানের আসর, খোলা পরিবেশে মনের আনন্দে গলা ছেড়ে আমরা গাইতে লাগলাম। ফোনে টাওয়ার নেই, কোনো কাজ নেই, কোনো দায়িত্ব নেই, সময়ের সঙ্গে তাল মেলানোর কোনো তাগিদ নেই ,কোনো তাড়া নেই। অনাবিল আনন্দের একমুঠো মুহূর্ত।
ডাক পড়লো রাতের খাওয়ার, কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নেমে পাশের ঘরে গিয়ে রাতের খাওয়া দাওয়া সারলাম। নাঃ আর বারান্দায় বসে আড্ডা মারা যাবে না ঠান্ডাটা বেশ বেড়েছে। আমাদের দুটো ঘর। একটা ঘরে গুটিসুটি মেরে বসলুম সব। শুরু হলো ভূতের গপ্পো। চারিদিক নিঃস্তব্ধ। প্রথমে অঞ্জন, তারপর পল্লবের ভূতের গপ্পে একেবারে জমে ক্ষীর আমাদের পাহাড়ী প্রথম নিশি। খেয়াল হলো ঘড়ি ১.৩০ পার করে দিয়েছে। ঘুমোনোর কারো কোনো ইচ্ছেই নেই। কিন্তু শুতেই হবে, কারণ কাল সকালে আবার বেড়োনো। তাই আর দেরি না করে গপ্পের ঝাঁপি পরের দিনের জন্য তুলে রেখে ঘুমোতে গেলাম।
পরের দিন খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো আমার। সবাই ঘুমোচ্ছে। ঘর থেকে বেড়িয়ে কাঠের সিঁড়িটা ভেঙে নেমে এলাম। সূর্য সবে উঠছে, যেদিকে তাকাই শুধু সবুজ আর সবুজ। আরো খানিকটা এগিয়ে গেলাম। প্রানভরে নিঃস্বাস নিতেই সবুজ বুনো গন্ধে প্রানটা ভরে গেলো। শুধু আমি আর প্রকৃতি, আর কেউ না।সময় এখানেই থমকে থাকুক। কিন্তু তা হবার নয়।
আমরা যেখানে ছিলাম তার সামনেই বক্সা ফোর্ট। সকালের সেই কাঠের বারান্দায় রোদ পোয়াতে পোয়াতে ল্যাদ খেতে খেতে আমরা জলখাবার সেরে আবার হাঁটাহাঁটির জন্য তৈরি হয়ে গেলুম। বক্সা ফোর্টেও একবার হানা দিলুম। বক্সাফোর্ট ঘুরে বক্সফোর্টের সামনেই থাকা একটা গুমটি থেকে অসাধারণ স্কোয়াসের মোমো খেয়ে পাড়ি দিলুম লেপচাখায় উদ্দেশ্যে।
...
কবিতা লেখা আমার কম্ম নয়। ওটি ঝেঁপেছি অঞ্জনের দেয়াল থেকে।
ডুয়ার্স সফরনামাঃ স্মৃতিসুধায়
ডুয়ার্স সফরনামাঃ পাহাড় থেকে নদী, নদী থেকে পাহাড়
Comments
Post a Comment