এপ্রিলে পাহাড় থেকে ফিরে এসেই আমরা তোড়জোড় শুরু করেছিলাম পুজোর। সারা বছরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া হোক বা না হোক পুজোর বেড়ানোটা একদম স্কুলের annual স্পোর্টস এর মতনই ফিক্সড থাকে। এবারের গন্তব্য ছিল উড়িষ্যার দারিংবাড়ি। টিকিট কাটা হয়ে গেল। অনলাইনে এ ঘর বুক করতে গিয়ে দেখি দারিংবাড়ির সব হোটেলের বুকিং ফুল। এদিকে ব্রহ্মপুরের টিকিট কাটা হয়ে গেছে। কোথায় যাওয়া যায় সেই নিয়ে খোঁজাখুঁজি করে ফাইনাল ডেস্টিনেশন ঠিক হল ফুলবনি, বেলঘর, তপ্তপানি এবং পুরী । আমাদের ফেরার ট্রেন ছিল পুরী থেকে তাই পুরীতেও এক চক্কর মেরেই আসবো ঠিক হলো। যাওয়ার আগে খুব একটা নিশ্চিত ছিলাম না কেমন হবে জায়গা গুলো; কি ভাবে রুট প্ল্যান করলে ঘোরাটা একদম ঠিকঠাক হবে তাও জানা ছিলনা, কারণ দারিংবাড়ির অনেক তথ্য অনলাইনে থাকলেও ফুলবনি আর বেলঘর এর ব্যাপারে খুব বেশি তথ্য নেট থেকে পাইনি। দুগ্গা দুগ্গা করে চারবন্ধুতে পাড়ি দিলুম অন্যরকম উড়িষ্যায়।
ব্রহ্মপুর থেকে গাড়িতে ফুলবনি ( প্রায় ১৬৫ কিমি) পৌঁছতে প্রায় সন্ধে হয়ে গিয়েছিল। ওই দিন ফুলবনিতে দুর্গা বিসর্জন হচ্ছিল। কলকাতা থেকে এত দূরে দুর্গা বিসর্জন যে এত জমজমাটি হতে পারে কোনো ধারণাই ছিল না । ওই রাত্তির টা ফুলবনিতে কাটিয়ে পরের দিন সকালে রওনা দিলাম বালিগুদার উদ্দেশ্যে। রাস্তায় দেখে নিলাম পাখাড়াঝোরা ফলস। ঘন্টা দুয়েক পর পৌঁছই বালিগুদায়। বেলঘর sanctuary তে সেভাবে দেখার কিছু নেই কিন্তু একটা ফরেস্ট গেস্ট হাউস আছে, জঙ্গলের মধ্যে ওইরকম কাঠের গেষ্টহাউসে থাকার উত্তেজনাটা একদম অন্যরকম, ওই গেস্ট হাউসে থাকার অনুমতি পাওয়া যায় বালিগুদার Devisional Forest Office থেকে।কিন্তু কপাল খারাপ, পেলাম না গেষ্ট হাউস, মন খারাপ হয়ে গেল। তখনই ওখানকার এক অফিসার বললেন পাশেই PWD র গেস্ট হাউসে একবার কথা বলে দেখতে। ওই গেস্টহাউসেই আলাপ হয় PWD র এক অফিসার শ্রীনু বাবুর সাথে। অসম্ভব কাজের এবং ভালো মানুষ, উনি পুরো ট্রিপটা আমাদের গুছিয়ে দেন। বেলঘরে ওই গেস্ট হাউস পাওয়া সম্ভব নয়, তাই শ্রীনু বাবুর suggestionএই আমরা বিকেল টা গাড়ি নিয়ে বালিগুদা থেকে ১৫ কিমি দূরের জলের তোলার শিব মন্দির আর ৬০ কিমি দূরে বেলঘর sanctuary ঘুরে pwd র বালিগুদায় গেস্ট হাউসে ফিরে এসে রাত্তিরটা ওখানেই কাটাই। পরের দিন আমাদের তপ্তপানিতে OTDC তে বুকিং ছিল।
আমরা ঠিক করি দারিংবাড়ি ঘুরে তারপর তপ্তপানি যাবো। সকলেই বেরিয়ে পড়ি দারিংবাড়ির উদ্দেশে । আমাদের ড্রাইভার কে শ্রীনু বাবু সব ডিটেলে বুঝিয়ে দেন। Lover's point, এমু পার্ক, nature পার্ক, হিল ভিউ পয়েন্ট, দাসিংবাড়ি ফলস, কফিবাগান ঘুরে তপ্তপানি পৌঁছলাম তখন বিকাল প্রায় ৪.৩০ টে। OTDC তে না নেমে গাড়ি নিয়ে চলে গেলাম আরো ৪৫ কিমি চন্দ্রগিরি পাহাড়ের ওপরে জিরঙ্গে পদ্মসম্ভব মহাবিহার বৌদ্ধমঠে। ফিরে আসতে আসতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। ভরা পূর্ণিমায় পাহাড়ের জঙ্গলের কোলে OTDC র লগ হাউসেও বারান্দায় বসে মাঝরাত অব্দি আড্ডা দিয়ে লম্বা ঘুম দিলুম। পরের দিন সকালে তপ্তপানি র উষ্ণ প্রস্রবণ দেখে রওনা দিলুম ব্রহ্মাপুর স্টেশন এর উদ্দেশ্যে। ট্রেনে করে চলে এলাম পুরী। সেখানে এক রাত্তির থেকে পরের দিন ধৌলী এক্সপ্রেস ধরে ফিরে এলাম নিজ নিজ ভবনে।
সত্যি বলতে যাওয়ার আগে ভেবেছিলাম, কটা দিন একইরকম ভাবে চলতে থাকা জীবন থেকে একটু ফুরসৎ মিলবে, আড্ডা মজায় নতুন জায়গায় দিব্বি কেটে যাবে কটা দিন। কিন্তু এত অপূর্ব প্রকৃতির সাক্ষাৎ পাবো ভাবতেই পারিনি। প্রকৃতি সপরিবারে দোসর হয়েছিল আমাদের উড়িষ্যার বহেমিয়ানায় ....একসাথে পাহাড়, জঙ্গল, নদী, ঝর্ণা, সমুদ্র, প্রস্রবণ....কখনো ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি,কখনো ঝলমলে রোদ্দুর, কোজাগরী পূর্ণিমার- চাঁদ, তারমধ্যে আকাশে পেঁজা তুলোর মতন শরতের মেঘ। শরীর মন ভরিয়ে রসদ নিয়ে ফিরে এলাম। একটা বছরের জন্য যথেষ্ট । আসছে বছর আবার হবে।


Comments
Post a Comment