Skip to main content

পুরনো কাসুন্দি

সালটা ২০০৮, বাবা মারা যাওয়ার কিছু মাস পর, আমার পরম পূজনীয় জননী একটু সামলে উঠতেই, স্থির করলেন এখন থেকে ওনার জীবনে একম-অদ্বিতীয়ম লক্ষ্য হলো আমার বিয়ে দেয়া। ভেবেছিলো আমায় "পার" করেই সব কাজ মিটে যাবে, আমি খাবো বাঁশ এবং তিনি ড্যাং ড্যাং করে বাবার কাছে চলে গিয়ে সুখে - শান্তিতে করবেন স্বর্গবাস। তখনও কুমার বাহাদুরের আগমন ঘটেনি বলাই বাহুল্য। মাকে আমি বুঝিয়ে উঠতে পারতাম না যে, দেখে-শুনে বিয়ের জগতে আমার "দাম " নেই বললেই চলে। বিয়ের খদ্দেরদের ফর্সা, সুন্দরী, স্লিম এবং শিক্ষিত মেয়ে চাই। অনেকের আবার শিক্ষিত হলেও আপত্তি। সুতরাং সে গুড়ে রাশি রাশি বালি। তবুও মার অদম্য ইচ্ছে, শারীরিক এবং মানসিক অবস্থা এবং ইমোশনাল কাতুকুতুর কাছে হার মেনে "দেখে-শুনে বিয়ে" পুজোর জোগাড়ে নেমে পড়ি।
এই পুজোর সর্বপ্রথম নিয়ম, সুন্দর শাড়ি পরে, ভালো করে সাজুগুজু করে একটি ছবি তুলতে হবে।যাতে পাত্রপক্ষ ঝপ করে দেখে টপ করে পছন্দ করে ফেলে। তাই হলো সুন্দর সাজু গুজু এবং শাড়ী পরে ছবি তোলা হলো। এই ছবিটি যে কত জায়গায় ঘুরেছে তার ঠিক নেই। আত্মীয়-পরিজন, ম্যাট্রিমনিয়াল সাইট, কুরিয়ার অফিস, খবরের কাগজের অফিস, ই-মেল, ঘটক আরো কত শত জায়গা। অনেক গুলো কপি বানানো হয়েছিল। এবং লিফলেট বিতরণের মতন, যার কাছেই "যোগ্য" পাত্র থাকতো তাকে বিতরণ করে দেয়া হতো, উইথ বায়ো -ডাটা।
এখন যত হালকা ভাবে কথা গুলো লিখছি, তখন ততোধিকই ভারী ছিল মনের অবস্থা। আত্মসম্মানকে জলাঞ্জলি দিয়ে একের পর এক প্রচেষ্টায় মার সাথে থাকা। মাও জানত, মার মোটা এবং কালো মেয়েকে "পার" করা খুব শক্ত। বুঝতে পারতাম মার ভীষণ কষ্ট হয় এরকম বার বার আমায় একই পরিস্থিতির মধ্যে ফেলতে। তবুও তিনি না থাকলে কে আমায় দেখবে এই চিন্তায় এবং অবশ্যই সামাজিক চাপের চাকায় নিজেকে এবং আমাকে পিষতে বাধ্য হতো। আমি বেচারি বা অবলা ছিলামনা। বাধা দিতেই পারতাম, বারণ করতেই পারতাম। কিন্তু আমি দেখেছিলাম বাবার চলে যাওয়ার পর সেই প্রথম মা আস্তে আস্তে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে, যেন একটা উদ্দেশ্য খুঁজে পেয়েছে বেঁচে থাকার। বিয়েটা হওয়া এত সহজ নয়, আমি জানতাম। তবু এই খেলায় ভুলে যদি একটু স্বাভাবিক থাকে তো থাকুক না। এই ভেবেই আত্মসম্মানের মাথায় বাড়ি মেরে এবং ইচ্ছেগুলোকে সাইলেন্ট মোডে পাঠিয়ে, মা'র হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মিলিয়েছিলাম।
যাই হোক হঠাৎ করে এই পুরোনো কাসুন্দি ঘাটার কারণ হলো,একটা ছবি। হঠাৎ করে খুঁজে পাওয়া সেই লিফলেট থুড়ি সেই ছবি৷ একটা দরকারে পুরোনো দরকারি মেল খুঁজতে গিয়ে, আরো কয়েকটা পুরোনো হাবিজাবি মেল চোখে পড়লো।মার পছন্দ করা কিছু যোগ্য পাত্রপক্ষকে ই-মেলে ছবি পাঠিয়েছিলাম, সেই খান থেকে ছবিখানা পেয়ে পুরোনো সবকিছু ঝপাঝপ মনে পড়ে গেল। তবে ভাবলুম জীবনে সবসময় ভালোটা ছেঁকে খারাপটা ঝেড়ে ফেলি, এটাইবা বাদ যায় কেন৷
ভাগ্যিস ফর্সা, সুন্দরী, স্লিম, শিক্ষিত বা অশিক্ষিত ছিলুম না, ভাগ্যিস দেখা-শোনা বিয়ের বাজারে দাম ছিল না, ভাগ্যিস কারো পছন্দ আমি ছিলাম না, ভাগ্যিস - ভাগ্যিস-ভাগ্যিস। ভালো কিছু পেতে গেলে দাম তো দিতেই হয়, সব কিছুর দাম দিতে হয়। এই যে এত দাম দিয়েছি, তাই হয়তো আজকের ভালোথাকাটাকে সুদ সমেত ফেরত পেয়েছি। আমার কুমার বাহাদুরকে পেয়েছি৷

(বি.দ্র. এই ছবিটি কুমারের অতীব অপছন্দের, ওর কথায় ছবিটায় নাকি প্রাণ নেই। এর থেকে ঢের ভালো ছবি আছে নাকি আমার। জেলাস জেলাস ...

Comments

Popular posts from this blog

একটা চেয়ার আর কিছু গল্পকথা

দোলনা চাপতে কার না ভালো লাগে....আমার তো ছোটবেলা থেকেই দোলনার প্রতি অমোঘ আকর্ষণ...কিন্তু মুশকিলটা ছিল মানুষটা আমি ছোট থেকেই বেশ মোটাসোটা, ফলত দোলনা চাপলেই আশপাশ থেকে কেউ না কেউ বলে উঠত "এইরে দোলনাটা ভেঙে পড়ল বলে" বা "দোলনাটা হাতিদের চড়ার জন্য নয়" আরও কত কি...খুব কষ্ট হত.... কষ্টে ঝপাং ঝাপ দিয়ে নেমে পড়তাম। তখন কলেজে পড়ি...আমার সবথেকে ভালো বন্ধুর বাড়ির উল্টো দিকে একটা পার্ক ছিল...প্রথম দিনই ওদের বাড়ি যাওয়ার সময় লক্ষ্য করেছিলাম ওই পার্কটিতে দুটো দোলনা আছে এবং যার সামনে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল "২-৫ বছরের শিশুদের জন্য" ... তাতে কি !!! প্রথম ভালোবাসার টানে মানুষ সব অন্যায় করতে পারে ... যেদিন ওদের বাড়ীতে রাত্তিরে থাকতাম ... ৬টার পর পার্ক বন্ধ হয়ে গেলে ... অন্ধকারে ছোট পাঁচিল টপকে আমরা পার্কে ঢুকতাম ... আর মনের আনন্দে আমি দোল খেতাম ... ভাবলাম কি ভালো ... কেউ কিছু বলার নেই বারণ করার নেই ... কোন সময় সীমা নেই যতখুশি যতক্ষণ খুশি দোল খাও। এইভাবে ২-৩ বার সাধ পুরণের পরই ... একদিন পার্কের পাশের বাড়ী থেকে চিৎকার শোনা গেল "কে?? কেএএএ? কারা পার্কে?? প্রায়ই পার্ক বন্ধ হব...

চিরসখা "সন্দেশ"

কাল সন্ধ্যেয় নানা রকম গপ্পের মধ্যে কথায় কথায় "সন্দেশ" এর কথা উঠলো। কুমার বাহাদুরের জীবনে দুরকম সন্দেশই কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা মোটামুটি ওর কাছের লোকজন সবাই জানে। এক সন্দেশে তার উদরতৃপ্তি ঘটে আরেক "সন্দেশ" তার মনের আরামের খোরাক। সেই ৯৫ সালে মেজপিসি "সন্দেশ" পত্রিকার গ্রাহক করে দিয়েছিলো। তারপর থেকেই কুমারের অন্তরতম সঙ্গী হয়ে ওঠে "সন্দেশ"। গত ২৫ বছরের সন্দেশের সব সংখ্যাই আছে বোধকরি ওর সংগ্রহে আছে। এখনো অন্যান্য যেকোনো পুজোসংখ্যার আগে "সন্দেশ" কবে বেড়োচ্ছে সে খবর জোগাড়ে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ থাকে। আমায় আগেও বলেছিলো, কাল যখন "সন্দেশ" এর কথা উঠলো, হঠাৎ মনে পড়ে গেলো। জিগালুম,  সন্দেশে তোমার একবার লেখা বেড়িয়েছিলো না??? হ্যাঁ, হাত পাকাবার আসরে। তোমার কাছে আছে সেই সংখ্যাগুলো?? থাকবে না কেন!! বের করোতো। এমনিতে তো ভুলোরাম, কোথায় কি রাখে দুমিনিট অন্তর ভুলে যায়, কিন্তু নিজের আজীবন দোসরদের খুঁজে পেতে তার বিন্দুমাত্র দেরী হয় না। বলতে না বলতে নিয়ে চলে এলো। ৪ টে গল্প বেড়িয়েছিলো, একটা গল্পের সাথে একটা ছবিও ছিল কিন্তু সেটা কোনো কা...

কন্যের কেশ কথন

ছোটবেলা থেকেই আমার লম্বা ঘন চুল ছিল। খুব ভালো লাগতো আমার। মা মাঝে মধ্যে গজগজ করতো। তার কারণও ছিল অবশ্য। সকালে স্কুলে বেড়োতাম ৮.৩০ টায়। ভোর বেলা উঠে কাজ গুছিয়ে, রান্না করে, আমার টিফিন তৈরি করে তারপর বসতে হত মাকে আমার চুল বাঁধতে। স্কুলের নিয়ম ছিল বড় চুল মানেই দুটো বিনুনি বেঁধে যেতে হবে। প্রায়ই বলত,"উফ তোর চুল বাঁধতে আমার হাত ব্যথা হয়ে যায়, দেব ছোট করে এবার।" আমার সাপোর্টে সবসময় ছিল বড়মা। বলত চিন্তা করিস না; তোর মা অমন বলছে, আমি কাটতে দেবই না তোর চুল। আর তাছাড়া আমিও জানতাম মার ওসব কথার কথা। একটু বড় হতে মজা করে যদি বলতাম ভাবছি চুলটা কেটেই দেবো, ওমনি বড়বড় চোখ পাকিয়ে বলতো, "খবরদার, একদম নয়।" সেই থেকে লম্বা ঘন একঢাল চুল। খুব ভালো লাগতো আমার। দেখতে শুনতে কোনদিনই তেমন ছিলাম না। কিন্তু আমার চুল দেখেই নিজেরই মন ভরে যেত। স্কুল থেকে ফিরলে সন্ধ্যে বেলায় মা কালো কার দিয়ে বেড়া বিনুনি বেঁধে দিত। কি যে অদ্ভুত দেখতে লাগতো তারপর কি বলবো। রাত্তির বেলায় চিত হয়ে শুতেই পারতুম না, ঘাড়ে ব্যথা হয়ে যেত, পাশ ফিরে শুতে হতো ।  বাবা মারা যাওয়ার পর, নিয়ম-কানুন মেটার ১৩ দিন পর যখন চুল ...