আমাদের এখানে জগদ্ধাত্রী পুজো মানেই সারা বছরের অপেক্ষার উৎসব। ঠাকুর দেখায় ছোট থেকে খুব একটা উৎসাহ ছিল না, কারণ বেশিদূর অব্দি হাটা হাটি করতে পারতুম না। তবে জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই জগদ্ধাত্রী নবমী মানেই মা র সাথে তেঁতুলতলা অভিযান। তেঁতুলতলার জগদ্ধাত্রী ঠাকুর bhadreswar এর সবচেয়ে বিখ্যাত পুজো। কোনো ঝকমকে থিম প্যান্ডেল নয়, সাবেকি সাজে সাধারণ নাটমন্দিরের প্রতিমা। বহুদূর থেকে মানুষ আসেন পুজো দেখতে। অষ্টমির সন্ধ্যে থেকে লাইন পরে নবমী পুজোর জন্য। এই অঞ্চলের সকলেরই, নবমীর খানিকটা সময় তেঁতুলতলার জন্য বুক থাকবেই থাকবে। খুব ছোট বেলায় এত ভিড় হতো বলেই মা আমাকে একবার ঠাকুর দেখিয়ে এনেই মন্দিরের ঢোকার কিছুটা আগে বাবাদের রাজনৈতিক দলের যে বুক কাউন্টার থাকতো, সেখানে বাবার কাছে বসিয়ে দিয়ে যেত। সেই থেকেই নবমীর তেঁতুলতলা যাওয়াটা একরকম যেন অভ্যেসই হয়ে গেছে।
এই বছরও নবমীর সকালে উঠেই মাকে ফোনে বলে দিলাম আমরা যাচ্ছি। মা র তো সব আনন্দই আমায় ঘিরে, তাই সবার উৎসব ষষ্টি থেকে শুরু হলেও আমার মার কাছে আমি যেদিন যাই সেদিনই উৎসব শুরু। বেরোনোর জন্য তৈরি হচ্ছি, হঠাৎ ওপরে খুব জোর একটা আওয়াজ হওয়ায় ছুটে গিয়ে দেখি, মা মানে আমার শাশুড়ি মা বিছানা থেকে পড়ে গেছেন। তাড়াতাড়ি করে আমি,বাবা আর কুমার মিলে তুললাম, ভীষণ লেগেছে। বরফ ওষুধ দিয়ে আস্তে আস্তে শুইয়ে দিলাম। প্রচন্ড ব্যথায় ছাপে মুখ চোখ ভরে যাচ্ছিল। বাবা এসে বললো, "চিন্তা করো না, সেরম কিছু হয়নি, তবে এত জোরে পড়েছে তো আঘাতটা খুব জোর লেগেছে, ওষুধ দিয়েছে, ঠিক হয়ে যাবে। আমরা তো আছি, তুমি যাও।" কুমারও বললো,"আমি তো আছি, তোমায় পৌঁছে দিয়ে চলে আসবে, তুমি যাও।" ভীষণ এক টানাপোড়েন, চোখের সামনে এক মার শরীরের যন্ত্রণা, আবার যাবো না বললে, উৎসাহ-আনন্দ-অপেক্ষা ভেঙে আরেক মার মনের যন্ত্রণা। কিন্তু মা কে এই অবস্থায় দেখে কি করে যাই। এমনিতেই মানুষটা আমার ওপর বড্ড ভরসা করে, তারওপর এই ভাবে পরে গেছে, কষ্ট হচ্ছে দেখেও কিভাবে যাবো।তাই দ্বিতীয়টি করলাম। দুই মায়ের কষ্ট তারওপর নিজের মনের চাপ সব মিলিয়েই এত মেঘ জমলো যে, বেশ কয়েক পশলা ঝমঝমিয়ে বৃষ্টিও হয়ে গেল। ভাবলাম এই প্রথম নবমী আমার তেঁতুলতলার জগদ্ধাত্রী দর্শন হলো না। ঈশ্বর বিশ্বাস কি বিশ্বাস নয় জানিনা, একটা অভ্যেস যেটা ছোট থেকে করে এসেছি, সেটা হঠাৎ করে না হওয়ায় বড্ড কষ্ট হচ্ছিল।
এইসব ভাবতে,কাজ-কর্মে, মার দেখাশোনায় রাত্তির হয়ে গেল। সবকাজ গুছিয়ে ,মা কে খাওয়াতে বসেছি । মা দু এক গাল খেয়েই আমার হাত টেনে ধরে ভালোবাসা মেশান চোখে বললো, "আমার খুব মেয়ের শখ ছিল জানিস, কিন্তু পর পর দুটোই ছেলে হলো,এখন তোকে দিয়ে সেই কোটা পূর্ণ হচ্ছে ।" মার চোখের ওই ভালোবাসা দেখে আমরা সারাদিনের মনখারাপের ভার যেন অর্ধেক চলে গেল। মনে হলো এত শরীরের কষ্টর মধ্যে যদি এককণা মনের আরাম দিতে পারি, সেটুকুই প্রাপ্তি।
রাত্তিরের শোয়ার তোর জোর করছি। দেখি ফোনটা বাজছে, মা তো এত রাত্তিরে ফোন করে না, কি হলো? ফোনটা ধরতে মা বললো, "শুয়েই পড়েছিলাম জানিস। হঠাৎ কিছু কথা মনে হতে তোকে ফোন করলাম। তুই যখন আজ আসবিনা বললি, ভীষণ মনখারাপ হলো।কিন্তু তারপরই ভাবলাম, আমার মন খারাপ হলে তোর আরো মনখারাপ হবে আর কেনইবা মনখারাপ করবো।এই পরিস্থিতিতে যেটা করার ঠিক সেটাই করছিস, তোর মতন মেয়ে কটা মা পায়। মনখারাপ করিস না, শুয়ে পর।আমি ঠিক আছি, আমার জন্য ভাবিস না, তুই ওই মায়ের খেয়াল রাখ।"
তেঁতুলতলার মা'কে দেখা হলো না। তবে আমার দুই মার ভালোলাগার আর ভালোবাসার মোড়কে, মাটির বদলে রক্ত মাংসের সত্যি জগদ্ধাত্রী দর্শন হয়ে গেল নবমী তে।
Comments
Post a Comment