Skip to main content

সান্ধ্যভ্রমনের সাত পাঁচ

প্রতি বছর দুর্গা পুজোর পর কোথাও না কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়ই। বেড়িয়ে ফিরেই আমি ও কুমার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই, এই যে পরিমান হাঁটাহাঁটি আমরা বেড়াতে গিয়ে করছি সেই একই পরিমান হাঁটাহাঁটি আমরা রোজ করবো। ঠিক যেমন পরীক্ষা শিওরে সংক্রান্তি হলে নাওয়া খাওয়া ভুলে পড়তুম আর বলতুম, এবার থেকে "ঠিক-ঠিক" সারা বছর এই রকম ভাবেই পড়বো এবং পরীক্ষা শেষে হবার পর সেই "ঠিক-ঠিক" পুরোদস্তুর বেঠিক হয়ে পড়াশোনার হাল যেমনকার তেমনই থেকে যেতো । অনেকটা সেরকমই কঠিন পণ বলা যেতে পারে । আর যেহেতু প্রতিজ্ঞাটি কঠিন, তাই ঠান্ডায় জমে কঠিন হয়ে থাকলেও ঋতু বদলের সাথে ধীরে ধীরে তার রূপও বদলে যেতে থাকে, এই আর কি। যদিও পরের বছর বেড়িয়ে ফিরে আবার আমরা নতুন ভাবে পুনর্প্রতিজ্ঞ হই।
তো যাই হোক, সকালে দুজনেরই বেরোনো ও সংসারের কাজে (আসল গপ্পো হলো, ভোর বেলায় আমাদের স্বয়ংসত্তার মধ্যে যে কুম্ভকর্ণসত্তার প্রভাব পুরোদস্তুর বিরাজ করে, তা কাটিয়ে উঠে শরীরচর্চার দিকে মনোনিবেশ করা একে বারেই অসম্ভব ব্যাপার) প্রাতঃভ্রমন হয়ে ওঠে না। সারাদিনের সব কাজ মিটিয়ে রাত্তিরে সাড়ে আটটা নাগাদ আমরা সান্ধ্যভ্রমণে বেরোই। গত ৩ বছর ধরেই এই চলছে।
রাত্তির ৮.৩০-৯ টায় আমাদের গলি রাস্তা ঘাট বেশ ফাঁকা ফাঁকাই হয়ে যায়, প্রায় সব বাড়ি থেকেই বাজ পড়তে থাকা বিভিন্ন বাংলা-হিন্দি সিরিয়ালের আওয়াজ ভেসে আসে, রুটির দোকানগুলোতে গরম গরম রুটি কেনার অপেক্ষায় উপচে পরা ভীড়, সারাদিনের কাজকম্ম শেষে নানান বয়সীদের মোড়ের মাথায় আড্ডাবাজি চলে, ফাঁকা নিরালা রাস্তায় কানফোনে কপোত বা কপোতির পায়চারিও চোখে পড়ে। ঝিমঝিমে ঠান্ডায় রাত্তিরের নিরিবিলিতে হাঁটাহাঁটি কিন্তু দিব্যি লাগে।
তবে সব ভালোলাগার যেমন সাইড এফেক্ট থাকে, তেমনই নিঝুম সন্ধ্যায় থুরি রাত্তিরে, নিজেদের পরিচিত এলাকায় হাঁটাহাঁটির সাইড এফেক্ট হলো কিছু পরিচিত মানুষ বা পরিচিত মুখ। যারা নিজেদের ঝাঁপি থেকে সম্পূর্ন বিনামূল্যে নিজেদের অবাধ জ্ঞান বিতরণ করে আমাদের বাধিত করেন৷ গুটিকয়েক নমুনা দিইঃ
একদিন এক পরিচিত ভদ্রলোকের বাড়ির সামনে দিয়ে আমরা হেঁটে যাচ্ছি, তিনি নিজের বাড়ির রোয়াকে বসে ভুঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে পাশে দাঁড়ানো এক শীর্ণকায় লোকের সাথে গপ্পে মশগুল৷ হঠাৎ আমাদের দেখে কুমারের উদ্দেশ্যে উক্তি ছুড়লেন, ফলত আমাদের থামতেই হলো....
"আরে এই যে ভাই কোথায় চললে??"
"এই একটু হাঁটছি"
(হাঁটছি শোনার পরও) "হাঁটাহাঁটি, নাকি ইভিনিং ওয়াক??"
"হ্যাঁ৷"
এগোতে যাবো অমনি আবার,
"খুব ভালো খুব ভালো। কিন্তু দেখ এই ভাবে হাঁটলে কিন্তু হবে না। আরও জোরে হাত দুলিয়ে দুলিয়ে হাঁটতে হবে। তবে কাজ হবে।"
এই বলে উনি বসে বসে চলার ভঙ্গিমা দেখিয়ে আমাদের উদ্ধার করলেন৷ ওনার থেকে এই সঠিত ভাবে হাঁটার টিপস পেয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা খুঁজে না পেয়ে,শুধুমাত্র একটা দেঁতো হাসি দিয়ে এগিয়ে যাওয়াই শ্রেয় মনে করে আবার হাঁটা লাগালুম।
আরেকদিনের ঘটনা। আমরা যাচ্ছি , পাড়ার মুদিখানা দোকান টা সামনেই, তাই কুমার জিগেস করলো কিছু লাগবে কিনা৷ আমি উত্তর দিতে যাবো, দোকানে দাঁড়িয়ে থাকা একজন আধ পরিচিত ভদ্রলোক বলে উঠলেন,
"এই - এইটে করলে কিন্তু চলবে না, হাঁটার সময় কোনো কথা বলা যাবে না। ওই গপ্পো করতে করতে হাঁটলে কিন্তু তার কোনো ফল নেই কো।"
ওনার এই জ্ঞান বার্তা শুনেই আমার হেড অফিস চিরবিড়িয়ে উঠলো, কুমার এস usual দেঁতো হাসি দিলো৷ আমি অতি কষ্টে ভদ্রলোকের দিকে একটা ফ্ল্যাট লুক দিতেই তিনি বুঝলেন ওনার জ্ঞানে কেউই ইন্টারেস্টেড নন, ফলত মানে মানে উনি কেটে পড়লেন।
একদিন এরকমই যাচ্ছি, এক পরিচিত ভদ্রমহিলা আমাদের পিছন থেকে হাঁক দিলেন,
"এই টুকুন (কুমারের ডাকনাম) বাড়িতে কারো কিছু হলো নাকি ?"(দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হলাম)
"কৈ নাতো!! কেনো??"
"না এমন হনহনিয়ে যাচ্ছিস, তাই ভাবলাম কারো কিছু হলো নাকি।"
"না না, একটু হাঁটতে বেরিয়েছি৷"
"ও বাবা!!তা এই রাত বিরেতে কেন???"
"ওই আর কি"
"না না এটা একদম ঠিক নয়, রাত্রে বাতাসে অক্সিজেন কম থাকে, রাত্রে হাঁটা খুব খারাপ। ভোর ভোর উঠবি সকালে হাটবি। দেখবি শরীর মন দুই ফ্রেশ থাকবে।"
কুমার স্বভাব বসত দাঁত বের করে হ্যাঁ বা না কিছু একটা বলার চেষ্টা চালাচ্ছে দেখে আমিই বললুম
"যাই হ্যাঁ, তাড়া আছে।"
"হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই, কিন্তু যেটা বললাম মাথায় রেখো কিন্তু মা।"
মাথাটা আমার যে পরিমান বিরক্তির তাতে তেতে ছিল, কথা গুলো মাথায় ঢোকার সাথে সাথেই বাষ্প হয়ে যে কোন দিয়ে বেরিয়ে গেছে আমি নিশ্চিত। মাঝে মাঝে মনে হয় এনাদের জ্ঞানের সিন্দুকে তালা মারতেই , কুম্ভকর্ণ সত্তাকে জলাঞ্জলি দিয়ে সান্ধ্যভ্রমণকে প্রাতঃ ভ্রমণে ট্রান্সফার করতে হবে।
তবে যাই হোক, এই এনাদের মতন লোকজনের জন্য আমার মেজাজ যতই কিটকিট করুক, কুমার বাহাদুরের মতানুসারে এই বিষয় গুলো হচ্ছে চরম খিল্লির। তারওপর এইসব শুনে যেহেতু আমার মাথা কিটকিট করে ফলতঃ ওর কাছে সেটা added খিল্লি। আর এই খিল্লিবাজি করেই সে আমার কিটকিটে মেজাজকে নিমেষে কুড়মুড়ে করে দেয়। বলে এইগুলো না থাকলে জীবনের কুড়মুড়ে ব্যাপারটাই নাকি হারিয়ে যায়। তাই এই সাত পাঁচ ছাড়া আমাদের সান্ধ্যভ্রমণ একেবারেই অসম্পূর্ণ৷

Comments

Popular posts from this blog

একটা চেয়ার আর কিছু গল্পকথা

দোলনা চাপতে কার না ভালো লাগে....আমার তো ছোটবেলা থেকেই দোলনার প্রতি অমোঘ আকর্ষণ...কিন্তু মুশকিলটা ছিল মানুষটা আমি ছোট থেকেই বেশ মোটাসোটা, ফলত দোলনা চাপলেই আশপাশ থেকে কেউ না কেউ বলে উঠত "এইরে দোলনাটা ভেঙে পড়ল বলে" বা "দোলনাটা হাতিদের চড়ার জন্য নয়" আরও কত কি...খুব কষ্ট হত.... কষ্টে ঝপাং ঝাপ দিয়ে নেমে পড়তাম। তখন কলেজে পড়ি...আমার সবথেকে ভালো বন্ধুর বাড়ির উল্টো দিকে একটা পার্ক ছিল...প্রথম দিনই ওদের বাড়ি যাওয়ার সময় লক্ষ্য করেছিলাম ওই পার্কটিতে দুটো দোলনা আছে এবং যার সামনে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল "২-৫ বছরের শিশুদের জন্য" ... তাতে কি !!! প্রথম ভালোবাসার টানে মানুষ সব অন্যায় করতে পারে ... যেদিন ওদের বাড়ীতে রাত্তিরে থাকতাম ... ৬টার পর পার্ক বন্ধ হয়ে গেলে ... অন্ধকারে ছোট পাঁচিল টপকে আমরা পার্কে ঢুকতাম ... আর মনের আনন্দে আমি দোল খেতাম ... ভাবলাম কি ভালো ... কেউ কিছু বলার নেই বারণ করার নেই ... কোন সময় সীমা নেই যতখুশি যতক্ষণ খুশি দোল খাও। এইভাবে ২-৩ বার সাধ পুরণের পরই ... একদিন পার্কের পাশের বাড়ী থেকে চিৎকার শোনা গেল "কে?? কেএএএ? কারা পার্কে?? প্রায়ই পার্ক বন্ধ হব...

চিরসখা "সন্দেশ"

কাল সন্ধ্যেয় নানা রকম গপ্পের মধ্যে কথায় কথায় "সন্দেশ" এর কথা উঠলো। কুমার বাহাদুরের জীবনে দুরকম সন্দেশই কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা মোটামুটি ওর কাছের লোকজন সবাই জানে। এক সন্দেশে তার উদরতৃপ্তি ঘটে আরেক "সন্দেশ" তার মনের আরামের খোরাক। সেই ৯৫ সালে মেজপিসি "সন্দেশ" পত্রিকার গ্রাহক করে দিয়েছিলো। তারপর থেকেই কুমারের অন্তরতম সঙ্গী হয়ে ওঠে "সন্দেশ"। গত ২৫ বছরের সন্দেশের সব সংখ্যাই আছে বোধকরি ওর সংগ্রহে আছে। এখনো অন্যান্য যেকোনো পুজোসংখ্যার আগে "সন্দেশ" কবে বেড়োচ্ছে সে খবর জোগাড়ে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ থাকে। আমায় আগেও বলেছিলো, কাল যখন "সন্দেশ" এর কথা উঠলো, হঠাৎ মনে পড়ে গেলো। জিগালুম,  সন্দেশে তোমার একবার লেখা বেড়িয়েছিলো না??? হ্যাঁ, হাত পাকাবার আসরে। তোমার কাছে আছে সেই সংখ্যাগুলো?? থাকবে না কেন!! বের করোতো। এমনিতে তো ভুলোরাম, কোথায় কি রাখে দুমিনিট অন্তর ভুলে যায়, কিন্তু নিজের আজীবন দোসরদের খুঁজে পেতে তার বিন্দুমাত্র দেরী হয় না। বলতে না বলতে নিয়ে চলে এলো। ৪ টে গল্প বেড়িয়েছিলো, একটা গল্পের সাথে একটা ছবিও ছিল কিন্তু সেটা কোনো কা...

সারপ্রাইজের জন্মদিন

বছরের একটা দিন আছে যেটা শুধু আমার, যেদিন সবাই আমার কথা শুনবে , আমার সব আবদার , দাবী মানতে আমি বাধ্য করবো , সবাই ভালো - ভালো কথা বলবে , সেই দিনের আমিই রাজা ৷ সেটা বছরের একটাই দিন ,জন্মদিন ৷ এবছর ৩১ হলো , থুড়ি মা'র কথায় ৩০+ ৷ মা'তো পারলে বয়সটা তিনেই আটকে রাখে ৷ তো যা বলছিলুম , জন্মদিন ... প্রতি বছর আমি আমার জন্মদিন নিয়ে প্রবল উৎসাহিত থাকি, হ্যাঁ নিন্দুকের মুখে ছাই দিয়ে বলব এই ৩১ এও আমার জন্মদিন নিয়ে উৎসাহে কোন ঘাটতি নেই আর আগামী যতগুলো বছর বাঁচবো একই উৎসাহপ্রথা চলতে থাকবে এ কথা হলফ করে বলতে পারি ৷ আগষ্ট মাস পড়লেই আমার মনে হতে থাকে ১২ তারিখ আসছে আসছে , মা'কে মনে করানোর দরকার পড়ে না , তিনি তো আমার এক কাঠি ওপরে ৷কিন্তু আমার ভুলো বরটা যাতে কোনভাবেই না ভোলে তার প্রস্তুতি পুরোপুরি নিয়েনি ৷ না বাবা , বর জন্মদিন ভুলে যাবে , তারপর জন্মদিনের সারাদিন মুড অফ করে মান - অভিমান করব, ঐ সব চক্কোরে আমি নেই ৷ তাই সপ্তাখানেক আগে থেকেই কাউন্টডাউন চালাতে থাকি ৷ যদিও ওর জন্য ঐদিন ভোলা খুব একটা সহজ না , একই দিনে বউ আর মা'র জন্মদিন হলে , সেইদিনটি ভোলা একটু চাপের ৷ প্রতি বছর কুমার বাহাদুর ঘোর চ...