একে অপরকে সইবার এবং একসাথে রইবার বয়স হলো চার। কুমার বাহাদুর আর আমি আজকের তারিখেই বিয়ের পিঁড়িঁ তে বসে এই অভূতপূর্ব দুর্ঘটনাটি ঘটিয়েছিলাম। যাইহোক দুর্ঘটনাটি যখন ঘটেই গেছিলো ভাবলাম ভালোই হলো, এক খানা বর পাওয়া গেল। বেশ নতুন নতুন একটা ব্যাপার। ছোট থেকে বাবা, মা ,জেঠু, বড়মা, পিসি, দাদাদের সাথে একই বাড়িতে, একই পরিবারে থেকেছি তাই নতুন বাড়ির বাবা, মা, জেঠুকে নিয়ে চিন্তা ছিল না কিন্তু এই বরের সাথে ঘর করাটা ঠিক কেমন হয়, তা নিয়ে বেশ একটা উৎসাহ ছিল।
গত ৪ বছর কুমার বাহাদুরের সাথে ঘর করে বর বলতে যা বুঝলাম তা অনেকটা দীপাবলি বা চৈত্রসেলের সময় পাওয়া বিভিন্ন কম্বো প্যাক অফারের মতন। একটি বরের প্যাকেজে মার স্নেহ, বাবার নির্ভরতা, ভাই-বোনের খুনসুটি, বন্ধুত্বের ভরসা আর জীবন দোসরের অফুরন্ত ভালোবাসা ফ্রী ফ্রী ফ্রী।
এই যেমন কখনো কখনো মায়ের মতন সবকিছু নিয়ে টিক টিক করে। মিথ্যে কথা বলে ঘুম ভাঙায় ৬ টা বাজলে বলে ৯ টা বেজে গেল। বই পড়তে পড়তে বা নেট ঘাটতে ঘাটতে ঘুমিয়ে পড়লে চোখ থেকে চশমা খুলে বই বা ফোন বন্ধ করে গায়ের কাঁথাটা ভালো করে জড়িয়ে দেয়। কোনো কষ্ট হলে, শরীর খারাপ হলে আমার থেকে বেশি পীড়িত হয়।জোর করে জলের বোতল হাতে ধরিয়ে সারাদিনে কতটা জল খাওয়া উচিত তার লেকচার দেয়। সমুদ্রে বেড়াতে গেলে হাত টা এমন চেপে ধরে থাকে যেন সমুদ্রের প্রতিটা ঢেউ ধেয়ে আসছে আমারই ফুলের মতন হালকা দেহটিকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, উফফ ... অসহ্য!!! এককথায় মোটামুটি মার মতনই তার জগতও আমাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়।
আবার কখন কুমারকে ঠিক বাবার মতন মনে হয়। বাবার মতোই আমি বাড়ী থাকলে কলেজ থেকে ফেরার সময় কিছু না কিছু আনেই। বেড়াতে যাওয়ার সময় বাস-ট্রেনের জানলার সিট টা আমার জন্যই রেখে দেয়। আমার সওওওব দরকারি কাগজপত্র ঘুছিয়ে সামলে রাখে। খেতে বসেই মাছের প্রথম ভাগটা তুলে রাখা থাকে আমার জন্য। বাবা যেমন হাসি, ইয়ার্কি, জমাটি গল্পে ভরিয়ে রাখতো কুমারের মধ্যেও তাই পাই। বাবার মতনই কুমারের কাঁধও আমার নিশ্চিন্তির ঘুমের ঠিকানা।
কখনও একদম পিঠোপিঠি ভাই বোনের মতন মারপিট করি, লুডো খেলায় চোট্টামি করে ঝগড়া করি, কাতাকুতু দিতে গেলেই সাত হাত দূরে লম্ফ দেয়। গরমের দুপুরে ছুটিতে আইসক্রিম দাদুর গাড়ী গেলেই একছুটে গিয়ে পেপসি কিনে, খাওয়ার পর জিভের রং কার কতটা গাঢ় সেই নিয়ে রেষারেষি শুরু হয়ে যায়।আমার সব কাজের ভার, সব দায়িত্ব সমান ভাবে ভাগ করে নেয়। আমার মাথার সব অদ্ভুতুড়ে প্রশ্ন, কিম্ভুত চিন্তা, মাথা-মুন্ডুহীন সমস্যার নির্ভরযোগ্য গুগলের ভূমিকাও সছন্দে পালন করে কুমার আমার।
সবচেয়ে ভালো বন্ধুর মতন আমার ভয়, মনখারাপ, কষ্ট গুলোকে চালনি দিয়ে চেলে নিয়ে নিমেষের মধ্যে উধাও করে দেয়। গল্প, আড্ডা, লুডো খেলা, সিনেমা দেখা, গঙ্গার ধারে হওয়া খেতে যাওয়া, ফুচকা খাওয়ার যোগ্য দোসর আমার।
আবার শরীরখারাপ হলে ওষুধ খাওয়াতে, শীতকালে জোর করে ক্রিম মাখাতে, অপছন্দের শাক সব্জি খাওয়াতে যা হাঙ্গামা আমায় করতে হয়, তাতে মাঝে মাঝে মনে হয় বিয়ে করে বর নয় একটা ধেড়ে খোকা দত্তক নিয়েছি।
তবে যাই হোক,বিয়ে করে পাওনার ঝুলিটা শুধু ভরেই গেল। এই ল্যাদখোর, চরম ভুলো, গেঁতো, বিরক্তকর, অসহ্য লোকটা আমার জীবনপাত্র সত্যি উচ্ছলিয়া দিলো। শুধু সংসারে আটকে না থেকে নিজের জন্য, নিজের ভালোলাগার জন্য সময় বের করতে শেখালো। ওর জন্যই ইচ্ছে হেঁসেল, ওর জোরাজুরি তেই লেখালেখি, নিজেই ব্লগ খুলে দিয়ে ও টাইপ করে, তাড়া লাগাতো পরের লেখার জন্য। কুমার বাহাদুরের মতন জীবন দোসর পেলে আর সত্যি কিচ্ছু লাগে না। জীবনের না দেখা দিক গুলো হঠাৎ করেই সামনে এসে যায়, না জানা ইচ্ছে গুলো পূরণ হয়ে যায়, না পাওয়া স্বপ্ন গুলো সত্যি করার ইচ্ছে জাগে, মাথার মধ্যে পাকিয়ে থাকা গিঁট গুলো আলগা হয়ে সহজ হয়ে যায়। শত সমস্যায় ভালো থাকার রসদ গুলো ঠিক জোগাড় হয়ে যায়।
দীর্ঘজীবি হোক আমাদের ভালোবাসা-বন্ধুত্ব-ঝগড়া-সহ্যশক্তি। শুভ চতুর্থ বন্ধুবার্ষিকী চিরসখা ...
Comments
Post a Comment