Skip to main content

স্মৃতি-শাপ

"তোমার পায়েসে কিন্তু মিষ্টি একদম কম দিয়েছে। রুমকি বললো তোমার সুগারটা বেড়েছে তো, তাই। খেয়ে নাও।"
মনোতোষ বাবু আজ ৭০ পূর্ণ করলেন। এতগুলো বছরে আজ প্রথম বার শিউলি দেবী নিজে হাতে জন্মদিনের পায়েস মনোতোষ বাবুকে খাইয়ে দিলেন। এতদিনের ঝড় ঝাপটায় কোথায় যেন হারিয়ে যাওয়া সেই ছোট্ট ইচ্ছেটার পূরণ ঘটে গেল মনোতোষ বাবুর জীবনে।
মনোতোষবাবু এবং শিউলিদেবীর ৩৫ বছরের বিবাহিত জীবন। দেখাশোনা করেই বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের আগের নিজেদের মনের ভাঙা-গড়ার সব গল্প স্বছন্দে বলেছিলেন একে অপরকে। দুজনেই চেয়েছিলেন একে অপরকে জীবন দোসর বানিয়ে, নতুন ভাবে সবকিছু শুরু করতে। কিন্তু যা ভাবা হয় বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই জীবন যেন তার উলটো পথ ধরে। মনোতোষ বাবুকে ধীরে ধীরে অসম্ভব ভালোবেসে ফেলেন শিউলি দেবী। এতটাই যে তার থেকে জন্ম নেয় অবিশ্বাস,সন্দেহ এবং ভুল বোঝাবুঝি।
প্রতি বছর মনোতোষ বাবুর জন্মদিনে প্রথম ফোনটা আসে মৃন্ময়ী দেবীর থেকে। "মৃন্ময়ী" — এই নামটাই মনোতোষ বাবু এবং শিউলি দেবীর সম্পর্কে হয়তো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ওনাদের সন্তানদের থেকেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই একটা নাম ঘিরেই সব সমস্যার সূত্রপাত। নিজের কোনো বোন না থাকায় ছোট থেকেই পাশের বাড়িতে থাকা মৃন্ময়ী দেবীকেই ছোট বোনের মতন দেখেছেন, স্নেহ করেছেন। কিন্তু শিউলী দেবীকে কোনদিনই তা বুঝিয়ে উঠতে পারেননি মনোতোষ বাবু। বার বার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তিক্ততার পারা টা একটু একটু করে বেড়েই গেছে।
প্রতি বছর এই ফোনটা আসলেই শিউলদেবীর চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, চোখ থেকে ঘেন্না-বিরক্তি ঝরে পড়ে। নিজের হাতে বানানো পায়েস টান মেরে ফেলে দেন ডাস্টবিনে। সারাদিন অশান্তির ঝড় বয়ে যায়।আজ সকালেও মৃন্ময়ীর আসা ফোনটাও শিউলী দেবীই ধরেছিলেন। একই ভাবে চোয়াল শক্ত হলো, বিরক্তি-ঘেন্নায় মনোতোষ বাবুর হাতে ফোনটা ধরিয়ে তড়িঘড়ি বেরিয়ে যান ঘর থেকে । কিন্তু আধ ঘন্টা পরই পায়েসের বাটি হাতে নিয়ে ফিরে আসেন।
‌গত বছর মনোতোষ বাবুর জন্মদিনে প্রতি বছরের মতনই একই ব্যাপার নিয়ে প্রচন্ড অশান্তি হয়। মেয়ে- জামাই, ছেলে-বৌমা সবাই মিলেও শিউলী দেবীকে বুঝিয়ে উঠতে পারেন না, তার এত বছরের ধারণা টা মিথ্যে। বয়সের ভার আর সাংঘাতিক মানসিক উত্তেজনার সে রাত্তিরেই সেরিব্রাল অ্যাট্যাক হয় শিউলী দেবীর। দিন তিন চারেকের যমে-মানুষে টানাটানির পর ডাক্তার বাবু জানান, শিউলী দেবী বিপদ সীমার বাইরে। তবে এই অ্যাট্যাক এর ফলে ওনার স্মৃতি-শক্তি দিনে দিনে কমতে থাকবে। যা বলবেন, যা করবেন সবই ভুলে যাবেন। মনোতোষ বাবু ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে, দু-হাতের মধ্যে মাথা গুঁজে দিশেহারা হয়ে বলতে থাকেন, "কি হবে? কিচ্ছু কি করা যাবে না?" ডাক্তারের নেতিবাচক উত্তরে ওনার শেষ আশাটুকুও দপ করে নিভে যায়।
‌আজকাল শিউলি দেবী সব ভুলে যান। সব কিছু মনে করিয়ে দিতে হয়, আবার ভুলে যান।আজ সকালে ফোনটার কথাও খানিক পরে ভুলে গেছিলেন। পুত্রবধূ রুমকি পায়েসের বাটি হাতে ধরিতে মনে করিয়ে দিয়েছিল আজ মনোতোষ বাবুর জন্মদিন।
কত বছর পর মনোতোষ বাবুর জন্মদিনটা এত ভালো কাটলো। শিউলী দেবীর হাতটা শক্ত করে ধরে বললেন ,"আজ তুমি খাইয়ে দাও"। শিউলী দেবীও চঞ্চল চোখে আশে পাশে কেউ আছে কিনা দেখে, আলতো হেসে জন্মদিনের আবদার মেটাতে পায়েসের চামচটা দ্রুত চালান করে দেন স্বামীর মুখে।





Comments

Popular posts from this blog

একটা চেয়ার আর কিছু গল্পকথা

দোলনা চাপতে কার না ভালো লাগে....আমার তো ছোটবেলা থেকেই দোলনার প্রতি অমোঘ আকর্ষণ...কিন্তু মুশকিলটা ছিল মানুষটা আমি ছোট থেকেই বেশ মোটাসোটা, ফলত দোলনা চাপলেই আশপাশ থেকে কেউ না কেউ বলে উঠত "এইরে দোলনাটা ভেঙে পড়ল বলে" বা "দোলনাটা হাতিদের চড়ার জন্য নয়" আরও কত কি...খুব কষ্ট হত.... কষ্টে ঝপাং ঝাপ দিয়ে নেমে পড়তাম। তখন কলেজে পড়ি...আমার সবথেকে ভালো বন্ধুর বাড়ির উল্টো দিকে একটা পার্ক ছিল...প্রথম দিনই ওদের বাড়ি যাওয়ার সময় লক্ষ্য করেছিলাম ওই পার্কটিতে দুটো দোলনা আছে এবং যার সামনে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল "২-৫ বছরের শিশুদের জন্য" ... তাতে কি !!! প্রথম ভালোবাসার টানে মানুষ সব অন্যায় করতে পারে ... যেদিন ওদের বাড়ীতে রাত্তিরে থাকতাম ... ৬টার পর পার্ক বন্ধ হয়ে গেলে ... অন্ধকারে ছোট পাঁচিল টপকে আমরা পার্কে ঢুকতাম ... আর মনের আনন্দে আমি দোল খেতাম ... ভাবলাম কি ভালো ... কেউ কিছু বলার নেই বারণ করার নেই ... কোন সময় সীমা নেই যতখুশি যতক্ষণ খুশি দোল খাও। এইভাবে ২-৩ বার সাধ পুরণের পরই ... একদিন পার্কের পাশের বাড়ী থেকে চিৎকার শোনা গেল "কে?? কেএএএ? কারা পার্কে?? প্রায়ই পার্ক বন্ধ হব

পুরনো কাসুন্দি

সালটা ২০০৮, বাবা মারা যাওয়ার কিছু মাস পর, আমার পরম পূজনীয় জননী একটু সামলে উঠতেই, স্থির করলেন এখন থেকে ওনার জীবনে একম-অদ্বিতীয়ম লক্ষ্য হলো আমার বিয়ে দেয়া। ভেবেছিলো আমায় "পার" করেই সব কাজ মিটে যাবে, আমি খাবো বাঁশ এবং তিনি ড্যাং ড্যাং করে বাবার কাছে চলে গিয়ে সুখে - শান্তিতে করবেন স্বর্গবাস। তখনও কুমার বাহাদুরের আগমন ঘটেনি বলাই বাহুল্য। মাকে আমি বুঝিয়ে উঠতে পারতাম না যে, দেখে-শুনে বিয়ের জগতে আমার "দাম " নেই বললেই চলে। বিয়ের খদ্দেরদের ফর্সা, সুন্দরী, স্লিম এবং শিক্ষিত মেয়ে চাই। অনেকের আবার শিক্ষিত হলেও আপত্তি। সুতরাং সে গুড়ে রাশি রাশি বালি। তবুও মার অদম্য ইচ্ছে, শারীরিক এবং মানসিক অবস্থা এবং ইমোশনাল কাতুকুতুর কাছে হার মেনে "দেখে-শুনে বিয়ে" পুজোর জোগাড়ে নেমে পড়ি। এই পুজোর সর্বপ্রথম নিয়ম, সুন্দর শাড়ি পরে, ভালো করে সাজুগুজু করে একটি ছবি তুলতে হবে।যাতে পাত্রপক্ষ ঝপ করে দেখে টপ করে পছন্দ করে ফেলে। তাই হলো সুন্দর সাজু গুজু এবং শাড়ী পরে ছবি তোলা হলো। এই ছবিটি যে কত জায়গায় ঘুরেছে তার ঠিক নেই। আত্মীয়-পরিজন, ম্যাট্রিমনিয়াল সাইট, কুরিয়ার অফিস, খবরের কাগজের অফিস, ই-মেল

টিকিটপুরাণ

পুজোয় বেড়াতে যাওয়ার টিকিট কাটা আর টানটান রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস পড়া একই ব্যাপার। প্রতি মুহূর্তের উত্তেজনা, এই ফসকে গেল গেল হৃদকম্পে রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার জোগাড় হয়। আমাদের আজ টিকিট কাটার পর্ব ছিল। নিজেরাই কাটি। দায়িত্ব থাকে কুমার বাহাদুরের ওপর। কাল রাত্তির থেকে যুদ্ধ চলছে। প্রতিবার বেড়াতে যাওয়ার আগে আমাদের whatsapp এ একটা গ্রূপ খুলে ফেলার দায়িত্বে থাকি আমি। যাওয়ার ঠিকানা বদলাতে থাকে , সঙ্গে গ্রূপের নামও। কাল রাত্তির থেকেই আমরা খুব উত্তেজিত, কারণ irctc র সাইট খুলে দেখা গেছে ৪ মাস আগে যে তারিখের টিকিট বুক করা যাচ্ছে, সেটা সেদিনই ওয়েটিং এ চলে যাচ্ছে। তাই একদম ঝপাঝপ কাজ সারতে হবে। নানা রকম আলোচনায় রাত্তির থেকে whtsapp এর গ্রূপ উত্তাল। বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মতামত, লক্ষ একটাই,কনফার্ম টিকিট চাই-ই চাই। সবার স্নায়ু টান টান কাল কি হবে, একেবারে ভারত-অস্ট্রেলিয়ার ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনাল খেলার মতন। রাতে শুয়েই পড়েছি হঠাৎ whtsapp গ্রূপে অংশুমানের মেসেজ রাত ১২ টার পর টিকিট কাটা যাবে মনে হয়। মেসেজ পড়া মাত্রই কুমার বাহাদুর ঝপ করে উঠে ল্যাপটপ খুলে বসল কিন্তু কোথায় কি !!! আবার অংশুমানের মেসেজ," না ১২ টা