Skip to main content

আভরণ

সাজগোজের সাথে সখ্যতা আমার কোনদিনই ছিল না। কলেজে ওঠার পর পৃথার পাল্লায় পরে যেটুকু শেখা। অন্য সব ব্যাপারে আমি ওর অভিভাবক হলেও এই সাজুগুজু ডিপার্টমেন্টে ওই ছিল আমার মেন্টর। এই টা কি পড়েছিস?? কাজল পরিসনি কেন?? টিপটা নাকের ডগায় পড়েছিস কেন ইত্যাদি ইত্যাদি শাসন চলতেই থাকতো। এখনও মাঝে মাঝে খ্যাচখ্যাচ করে, "তোকে আর মানুষ করতে পারলাম না, কতবার বলেছি বাইরে বেরোলে একটু মোটা করে কাজল পরে, সেজে গুজে বেড়োবি, তা না"।সত্যি বলতে ওর বোকা ঝকার জন্যই যেটুকু করা।
সবাই বলে জীবনে বিশেষ মানুষের আগমন ঘটলে মেয়েরা ভালো ক রে সাজগোজ করে। বিশেষ মানুষটিও খুব খুশি হয় তাতে। আমার ক্ষেত্রে সেটা একদমই উল্টো। কুমার বাহাদুরকেই আমায় বলতে হতো, দেখ ইনস্টিটিউটে এই আলুভাতে জামাটা পরে যেও না প্লিজ। পৃথার কথায় ইন্সপায়ার হয়ে ওই যতটুকু পারি সেজেগুজে কুমার বাহাদুরের সাথে বেরোলে, তিনি আমায় দেখে হেসেই খুন হতেন, এগুলো কি পড়েছ কানে গলায়??? ধুর তোমায় এমনিই ভালো লাগে। এমনিতেই সাজুগুজুর ব্যাপারে অপটু এবং কুঁড়ে, তারওপর এইরকম ভালোবাসার মানুষ, ফলত সে পাট একরকম চুকেই গেল।
ভাবলাম বিয়ের পর একটা বদল ঘটবে। সবার হাতে শাঁখা-পলা চুড়ি দেখে খুব ভালোলাগতো। পড়তামও। শীতকালে বিয়ে হয়েছিলো, যেই গরম টা পড়লো কি অস্বস্তি লাগতে আরম্ভ করলো কি বলবো। রান্না করতে গেলে পলা-লোহা যায় তেতে। কোনোদিন হাতে কিছু পড়া অভ্যেস ছিল না, আরো বিরক্ত লাগতে শুরু করলো। কুমার বাহাদুর তো বিয়ের পর থেকেই বলে ,"উফ এগুলো কি পরে থাকো??এই জবরজং গুলো খোলো তো" আমার নতুনবাড়িতে রীতি-নীতি আচারের কোনো বালাই নেই। ফলত শাঁখা-পলা পরতেই হবে এই চাপ কোনদিনই ছিল না। একদিন হাতে তেল ছিটকে চুড়ির ফাঁকে গেল ফোসকা পরে, ব্যস কুমার বাহাদুর টান মেরে শাঁখা-পলা-চুড়ি-নোয়া দিলো খুলে। আর বলল, কেউ যদি বলে কেন পরো না, বলবে আমি পরতে দিই না। আমিও যেন বেশ হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
সেদিন মা কে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছি, দুই ভদ্রমহিলা দেখছি অনেকক্ষণ ধরে আমার আপাদমস্তক মাপছেন। খানিক মাপ-যোগের পর ওনারা এক মহান আলোচনায় লিপ্ত হলেন এতই আস্তে যে সব কথাই আমার কর্ণগোচর হলো,
কি ব্যাপার বলতো, হাত খালি, অথচ মাথায় সিঁদুর??
স্বামী বোধহয় নেয় না!
তাই হবে, দেখতে শুনতেও তো ভালো নয়।
বেচারা, শোকে দুঃখে সব খুলে ফেলেছে, কিন্তু সিঁদুর মোছা কি অত সহজরে ভাই।
এই মহান আলোচনা সেরে ওনারা আবার আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির পোশাক কতটা কটু এবং এর জন্য তার বাবা-মার কতখানি লজ্জিত হওয়া উচিত সেই বিষয়ে আলোকপাত করতে মশগুল হয়ে গেলেন।
আমি কোনোরকমে দমফাটা হাসি চেপে মনে মনে ভাবলুম, হায় রে কুমার বাহাদুর, তোমার আমার এই অমোঘ ভালোবাসা চারটি শাঁখা-পলা-নোয়ার সামনে তুচ্ছ হয়ে গেল।
সামনেই নারী দিবস, সব নারিবাদীরা উচ্চই স্বরে পুরুষরা কিভাবে নারীদের বঞ্চনার শিকার করছে তার বর্ণনায় ব্যস্ত হয়ে পড়বে। কিন্তু ভাবছি আমার এই সামান্য হাতে কিছু না পরা বা হাত খালি রাখার জন্য কখনো না কখনো উষ্মা এবং বিরক্তি , উপদেশ ,ব্যথিত, চিন্তিত এই সব রকম অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটেছে দুই বাড়িরই নারী তথা মা, মাসি, মামীদের দ্বারা। যেহেতু আসে পাশের মানুষের প্রভাবে আমি সবসময়ই প্রভাবিত, কখন কখন নিজের ভালো না লাগা সত্ত্বেও আবার পড়তে শুরু করবও ভেবেছি। কিন্তু পুরুষ কুমার বাহাদুর বোঝায়," তুমি তো কোনদিনই এইসব ভালোবাসতে না। আজ হঠাৎ বিয়ের পর সেই ভালো না লাগায় তোমায় অভ্যস্ত হতে হবে কেন? যদি নিজের ইচ্ছে করে বা ভালো লাগে তবেই পরো নইলে শুধুমাত্র রীতি-নীতি মানার জন্য বা অন্য কারো কথায় জন্য,একেবারেই নয়। "
সালটা ২০১৮, এখনও এই সামান্য বিষয়েই যদি নারীই এত প্রশ্ন তোলে, তাহলে ঘটা করে নারী দিবস পালনের কোনো সার্থকতা বোধহয় থাকে না। দোষ তাদেরও নয়, চিরকাল তারা যা দেখে-মেনে-শুনে এসেছেন সেটাই চলতে থাকবে আশা করেন। নিজেরদের ভালো-মন্দ লাগার ব্যাপারে হয়তো কোনোদিনও ভেবে দেখারও ফুরসত পাননি, তাই ভাবেন রীতি-নীতি মানবে এতে আবার ভালোলাগা মন্দলাগার কি আছে। তাই এই নারী দিবসে একটাই আকাঙ্খা, আমরা কেউ যেন কারো ওপর কিছু চাপিয়ে না দিই। নিজের ইচ্ছে গুলো, ভালো লাগাগুলোই আভরণ হয়ে উঠুক আমাদের।

Comments

Popular posts from this blog

একটা চেয়ার আর কিছু গল্পকথা

দোলনা চাপতে কার না ভালো লাগে....আমার তো ছোটবেলা থেকেই দোলনার প্রতি অমোঘ আকর্ষণ...কিন্তু মুশকিলটা ছিল মানুষটা আমি ছোট থেকেই বেশ মোটাসোটা, ফলত দোলনা চাপলেই আশপাশ থেকে কেউ না কেউ বলে উঠত "এইরে দোলনাটা ভেঙে পড়ল বলে" বা "দোলনাটা হাতিদের চড়ার জন্য নয়" আরও কত কি...খুব কষ্ট হত.... কষ্টে ঝপাং ঝাপ দিয়ে নেমে পড়তাম। তখন কলেজে পড়ি...আমার সবথেকে ভালো বন্ধুর বাড়ির উল্টো দিকে একটা পার্ক ছিল...প্রথম দিনই ওদের বাড়ি যাওয়ার সময় লক্ষ্য করেছিলাম ওই পার্কটিতে দুটো দোলনা আছে এবং যার সামনে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল "২-৫ বছরের শিশুদের জন্য" ... তাতে কি !!! প্রথম ভালোবাসার টানে মানুষ সব অন্যায় করতে পারে ... যেদিন ওদের বাড়ীতে রাত্তিরে থাকতাম ... ৬টার পর পার্ক বন্ধ হয়ে গেলে ... অন্ধকারে ছোট পাঁচিল টপকে আমরা পার্কে ঢুকতাম ... আর মনের আনন্দে আমি দোল খেতাম ... ভাবলাম কি ভালো ... কেউ কিছু বলার নেই বারণ করার নেই ... কোন সময় সীমা নেই যতখুশি যতক্ষণ খুশি দোল খাও। এইভাবে ২-৩ বার সাধ পুরণের পরই ... একদিন পার্কের পাশের বাড়ী থেকে চিৎকার শোনা গেল "কে?? কেএএএ? কারা পার্কে?? প্রায়ই পার্ক বন্ধ হব...

চিরসখা "সন্দেশ"

কাল সন্ধ্যেয় নানা রকম গপ্পের মধ্যে কথায় কথায় "সন্দেশ" এর কথা উঠলো। কুমার বাহাদুরের জীবনে দুরকম সন্দেশই কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা মোটামুটি ওর কাছের লোকজন সবাই জানে। এক সন্দেশে তার উদরতৃপ্তি ঘটে আরেক "সন্দেশ" তার মনের আরামের খোরাক। সেই ৯৫ সালে মেজপিসি "সন্দেশ" পত্রিকার গ্রাহক করে দিয়েছিলো। তারপর থেকেই কুমারের অন্তরতম সঙ্গী হয়ে ওঠে "সন্দেশ"। গত ২৫ বছরের সন্দেশের সব সংখ্যাই আছে বোধকরি ওর সংগ্রহে আছে। এখনো অন্যান্য যেকোনো পুজোসংখ্যার আগে "সন্দেশ" কবে বেড়োচ্ছে সে খবর জোগাড়ে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ থাকে। আমায় আগেও বলেছিলো, কাল যখন "সন্দেশ" এর কথা উঠলো, হঠাৎ মনে পড়ে গেলো। জিগালুম,  সন্দেশে তোমার একবার লেখা বেড়িয়েছিলো না??? হ্যাঁ, হাত পাকাবার আসরে। তোমার কাছে আছে সেই সংখ্যাগুলো?? থাকবে না কেন!! বের করোতো। এমনিতে তো ভুলোরাম, কোথায় কি রাখে দুমিনিট অন্তর ভুলে যায়, কিন্তু নিজের আজীবন দোসরদের খুঁজে পেতে তার বিন্দুমাত্র দেরী হয় না। বলতে না বলতে নিয়ে চলে এলো। ৪ টে গল্প বেড়িয়েছিলো, একটা গল্পের সাথে একটা ছবিও ছিল কিন্তু সেটা কোনো কা...

পুরনো কাসুন্দি

সালটা ২০০৮, বাবা মারা যাওয়ার কিছু মাস পর, আমার পরম পূজনীয় জননী একটু সামলে উঠতেই, স্থির করলেন এখন থেকে ওনার জীবনে একম-অদ্বিতীয়ম লক্ষ্য হলো আমার বিয়ে দেয়া। ভেবেছিলো আমায় "পার" করেই সব কাজ মিটে যাবে, আমি খাবো বাঁশ এবং তিনি ড্যাং ড্যাং করে বাবার কাছে চলে গিয়ে সুখে - শান্তিতে করবেন স্বর্গবাস। তখনও কুমার বাহাদুরের আগমন ঘটেনি বলাই বাহুল্য। মাকে আমি বুঝিয়ে উঠতে পারতাম না যে, দেখে-শুনে বিয়ের জগতে আমার "দাম " নেই বললেই চলে। বিয়ের খদ্দেরদের ফর্সা, সুন্দরী, স্লিম এবং শিক্ষিত মেয়ে চাই। অনেকের আবার শিক্ষিত হলেও আপত্তি। সুতরাং সে গুড়ে রাশি রাশি বালি। তবুও মার অদম্য ইচ্ছে, শারীরিক এবং মানসিক অবস্থা এবং ইমোশনাল কাতুকুতুর কাছে হার মেনে "দেখে-শুনে বিয়ে" পুজোর জোগাড়ে নেমে পড়ি। এই পুজোর সর্বপ্রথম নিয়ম, সুন্দর শাড়ি পরে, ভালো করে সাজুগুজু করে একটি ছবি তুলতে হবে।যাতে পাত্রপক্ষ ঝপ করে দেখে টপ করে পছন্দ করে ফেলে। তাই হলো সুন্দর সাজু গুজু এবং শাড়ী পরে ছবি তোলা হলো। এই ছবিটি যে কত জায়গায় ঘুরেছে তার ঠিক নেই। আত্মীয়-পরিজন, ম্যাট্রিমনিয়াল সাইট, কুরিয়ার অফিস, খবরের কাগজের অফিস, ই-মেল...