Skip to main content

গানকাহন

আর পাঁচটা বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের মতন আমারও বয়সটা ৪-৫ হতেই মা হাত ধরে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে দিয়েছিল পাড়ার  গানের স্কুলে। মা মাসিরা গান শিখত, ভালো গাইতও; সেই পরম্পরা মেনে আমাকেও ভর্তি করা হলো। মা-মাসির হারমোনিয়াম বাড়িতে এলো। বাবার খুব প্রকট না হলেও একটু প্রচ্ছন্ন আপত্তি ছিলই যেমন থাকে, কারণ বাবার কথা ছিল আর যাই হোক পড়াশোনার কোনোরকম ক্ষতি যেন না হয়। মার ইচ্ছে এবং বাবার নিমরাজি ইচ্ছের মধ্যে আমি গিয়ে ভর্তি হলুম গানের স্কুলে। 

গান বা গান শেখার থেকেও আমার বেশি ভালোবাসা ছিল কাকিমা মানে আমার গানের গুরুর বাড়ির প্রতি। কারণ সেখানে ছিল আমার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু পাপু আর ছিল বুবুন দি। কাকিমার দুই মেয়ে। পাপু আর আমি পুতুল খেলায় সঙ্গী। ফলত শনিবার বিকেলে গান কতক্ষনে শেখা শেষ হবে সেই তালে থাকতাম। কারণ তার পরই খেলা আর হুল্লোড়। গানের প্রতি ভালোবাসা নয় বরং ওই আড্ডা, খেলা আর হুল্লোড়ই ছিল গান শিখতে যাওয়ার মূল আকর্ষণ।

মোটে ভাললাগত না গান করতে। সকাল বেলা টেনে তুলে মা রেওয়াজ করতে বসাত। যৌথ পরিবারে নিজের ইচ্ছে অনুসারে কন্যাসন্তানকে মানুষ করার অনেক যন্ত্রণা সহ্য করেই মাকে সেটা করতে হতো। ঘুম চোখ রগড়াতে রগড়াতে দরজা জানলা বন্ধ করে সা রে গা মা শুরু হতো। মনে হত এর থেকে খারাপ আর কিছুই হতে পারে না। তখন "দীপ নিবে গেছে মম" ছিল সেকেন্ড ইয়ারের সবচেয়ে ইম্পর্টেন্ট গান, "আমার মন মানে না" র  তাল, পর্যায় জেনে রাখা খুব জরুরি, "আমারও পরাণ যাহা চায়" ভালো করে মুখস্ত করতে হবে যদি সঞ্চারি থেকে গাইতে বলে। বিরক্ত লাগতো, ভাবতাম কতবার বললাম মাকে নাচ শিখবো, তা না সেই গানে ভর্তি করলো। কি না গান নাকি সবসময়ই সঙ্গে থাকবে, নাচ থাকবে না। ভবিষ্যতে রান্না করতে করতেও গান গাইতে পারবো কিন্তু নাচতে পারবো না! এইভাবেই চলল গান শেখা, ২৫শে বৈশাখে পাড়ার মাঠের অনুষ্ঠান, বার্ষিক অনুষ্ঠান। প্রতি বছরই প্রায় ২৫শে বৈশাখে ঝড় বৃষ্টি হতই, মনে মনে আনন্দ হত যাক আর ফাংশন হবে না। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই থেমে যেত। কাদার ওপর কাঠের গুঁড়ো ছড়িয়ে চারিদিক ঠিক ঠাক করা হতো আর তারপরেই মাইকে ঘোষণা, "আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের অনুষ্ঠান শুরু হবে।" অনুষ্ঠানসূচি অনুযায়ী কিছু নামের পরই ঘোষিত হতো "পরবর্তী রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশনা করবে শ্রীরূপা ঘোষ।" সব আনন্দ মাটি, দুরুদুরু বুকে, মার লালপাড় হলুদ বা সবুজপাড় হলুদ শাড়ী পড়ে কাদাতে টলমল করতে করতে স্টেজে গিয়ে কাঠের মতন বসে গান গেয়ে কোনোরকমে নেমে আসা। 

সেই সময় যখন খুব কাছে ছিলাম গানগুলোর, একটুও ভালোবাসতে পারিনি। মানেই বুঝতাম না। বুঝিনি "তোমায় নতুন করে পাবো বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ""যদি আরো কারে ভালোবাসা , যদি আরো ফিরে নাহি আস, তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও আমি যত দুখ পাই গো", "কেন মেঘ আসে হৃদয়ও আকাশে তোমারে দেখিতে দেয় না", "যা কিছু পাই হারায়ে যায় না মানে সান্ত্বনা", "তুমি জান না, আমি তোমারে পেয়েছি অজানা সাধনে", "তোমার চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া", "তুমি আমারি, মম অসীম গগন বিহারী" ...আরো অনেক এমনই কিছু শব্দ শুধু গানের লাইন নয় বেঁচে থাকার রসদ। ভালোবাসায়, মন খারাপে, আনন্দে। নতুন করে কিছু পেলে, হারিয়ে গেলে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত বাঁধা আছে ওনার লেখা প্রতিটি শব্দে। 

‌এখন সত্যি খুব ইচ্ছে করে আবার নতুন করে গানের স্কুলে ভর্তি হতে। এখন আর বাধ্য হয়ে নয় ভালবেসে, শব্দগুলোকে মন প্রাণ থেকে অনুভব করে গাইতে। হয় না, হয়েই ওঠে না আর। মা ঠিকি বলেছিলো, গান সবসময় সঙ্গে থাকে। সত্যি তাই, সেই মাধ্যমিকে গান শেখা ছেড়েছি কিন্তু গান আমায় ছাড়েনি। সে সবসময়ের সঙ্গী । রান্না করতে, খাতা দেখতে, ঘর গোছাতে, প্রেমে, মন খারাপে রবিগান বাজতেই থাকে আবার ইচ্ছে খুশি গাইতেও থাকি। গাইতে মোটেই ভালো পারি না তবু গাই। বাবার জন্য মনখারাপ হলে গাই, কুমারকে ভালোবেসে গাই, দুই মার আবদারে গাই, সারাদিন গরমে নাস্তানাবুদ হবার পর বিকেলে আকাশ ভর্তি কালো মেঘ দেখে ঝড়-বৃষ্টির আর রাত্রে ভালো ঘুম হবার আনন্দে গাই, নিজেকে ভালোরাখার জন্য গাই।

ভাগ্যিস মা সেই কুঁড়ি বয়সে জোড় করে ওনার গানজগতের সাথে আলাপ করিয়েছিল, নইলে কার ওপর এমন চোখ বন্ধ করে  সারাজীবনের সব অনুভূতির দায়ভার চাপিয়ে নিশ্চিন্তে জীবন কাটাতুম? তেনার গান ছাড়া সত্যি আমার কোনই গতি নেই!



ছবিঃ অনির্বাণ সেনগুপ্ত

Comments

Popular posts from this blog

একটা চেয়ার আর কিছু গল্পকথা

দোলনা চাপতে কার না ভালো লাগে....আমার তো ছোটবেলা থেকেই দোলনার প্রতি অমোঘ আকর্ষণ...কিন্তু মুশকিলটা ছিল মানুষটা আমি ছোট থেকেই বেশ মোটাসোটা, ফলত দোলনা চাপলেই আশপাশ থেকে কেউ না কেউ বলে উঠত "এইরে দোলনাটা ভেঙে পড়ল বলে" বা "দোলনাটা হাতিদের চড়ার জন্য নয়" আরও কত কি...খুব কষ্ট হত.... কষ্টে ঝপাং ঝাপ দিয়ে নেমে পড়তাম। তখন কলেজে পড়ি...আমার সবথেকে ভালো বন্ধুর বাড়ির উল্টো দিকে একটা পার্ক ছিল...প্রথম দিনই ওদের বাড়ি যাওয়ার সময় লক্ষ্য করেছিলাম ওই পার্কটিতে দুটো দোলনা আছে এবং যার সামনে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল "২-৫ বছরের শিশুদের জন্য" ... তাতে কি !!! প্রথম ভালোবাসার টানে মানুষ সব অন্যায় করতে পারে ... যেদিন ওদের বাড়ীতে রাত্তিরে থাকতাম ... ৬টার পর পার্ক বন্ধ হয়ে গেলে ... অন্ধকারে ছোট পাঁচিল টপকে আমরা পার্কে ঢুকতাম ... আর মনের আনন্দে আমি দোল খেতাম ... ভাবলাম কি ভালো ... কেউ কিছু বলার নেই বারণ করার নেই ... কোন সময় সীমা নেই যতখুশি যতক্ষণ খুশি দোল খাও। এইভাবে ২-৩ বার সাধ পুরণের পরই ... একদিন পার্কের পাশের বাড়ী থেকে চিৎকার শোনা গেল "কে?? কেএএএ? কারা পার্কে?? প্রায়ই পার্ক বন্ধ হব...

চিরসখা "সন্দেশ"

কাল সন্ধ্যেয় নানা রকম গপ্পের মধ্যে কথায় কথায় "সন্দেশ" এর কথা উঠলো। কুমার বাহাদুরের জীবনে দুরকম সন্দেশই কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা মোটামুটি ওর কাছের লোকজন সবাই জানে। এক সন্দেশে তার উদরতৃপ্তি ঘটে আরেক "সন্দেশ" তার মনের আরামের খোরাক। সেই ৯৫ সালে মেজপিসি "সন্দেশ" পত্রিকার গ্রাহক করে দিয়েছিলো। তারপর থেকেই কুমারের অন্তরতম সঙ্গী হয়ে ওঠে "সন্দেশ"। গত ২৫ বছরের সন্দেশের সব সংখ্যাই আছে বোধকরি ওর সংগ্রহে আছে। এখনো অন্যান্য যেকোনো পুজোসংখ্যার আগে "সন্দেশ" কবে বেড়োচ্ছে সে খবর জোগাড়ে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ থাকে। আমায় আগেও বলেছিলো, কাল যখন "সন্দেশ" এর কথা উঠলো, হঠাৎ মনে পড়ে গেলো। জিগালুম,  সন্দেশে তোমার একবার লেখা বেড়িয়েছিলো না??? হ্যাঁ, হাত পাকাবার আসরে। তোমার কাছে আছে সেই সংখ্যাগুলো?? থাকবে না কেন!! বের করোতো। এমনিতে তো ভুলোরাম, কোথায় কি রাখে দুমিনিট অন্তর ভুলে যায়, কিন্তু নিজের আজীবন দোসরদের খুঁজে পেতে তার বিন্দুমাত্র দেরী হয় না। বলতে না বলতে নিয়ে চলে এলো। ৪ টে গল্প বেড়িয়েছিলো, একটা গল্পের সাথে একটা ছবিও ছিল কিন্তু সেটা কোনো কা...

সারপ্রাইজের জন্মদিন

বছরের একটা দিন আছে যেটা শুধু আমার, যেদিন সবাই আমার কথা শুনবে , আমার সব আবদার , দাবী মানতে আমি বাধ্য করবো , সবাই ভালো - ভালো কথা বলবে , সেই দিনের আমিই রাজা ৷ সেটা বছরের একটাই দিন ,জন্মদিন ৷ এবছর ৩১ হলো , থুড়ি মা'র কথায় ৩০+ ৷ মা'তো পারলে বয়সটা তিনেই আটকে রাখে ৷ তো যা বলছিলুম , জন্মদিন ... প্রতি বছর আমি আমার জন্মদিন নিয়ে প্রবল উৎসাহিত থাকি, হ্যাঁ নিন্দুকের মুখে ছাই দিয়ে বলব এই ৩১ এও আমার জন্মদিন নিয়ে উৎসাহে কোন ঘাটতি নেই আর আগামী যতগুলো বছর বাঁচবো একই উৎসাহপ্রথা চলতে থাকবে এ কথা হলফ করে বলতে পারি ৷ আগষ্ট মাস পড়লেই আমার মনে হতে থাকে ১২ তারিখ আসছে আসছে , মা'কে মনে করানোর দরকার পড়ে না , তিনি তো আমার এক কাঠি ওপরে ৷কিন্তু আমার ভুলো বরটা যাতে কোনভাবেই না ভোলে তার প্রস্তুতি পুরোপুরি নিয়েনি ৷ না বাবা , বর জন্মদিন ভুলে যাবে , তারপর জন্মদিনের সারাদিন মুড অফ করে মান - অভিমান করব, ঐ সব চক্কোরে আমি নেই ৷ তাই সপ্তাখানেক আগে থেকেই কাউন্টডাউন চালাতে থাকি ৷ যদিও ওর জন্য ঐদিন ভোলা খুব একটা সহজ না , একই দিনে বউ আর মা'র জন্মদিন হলে , সেইদিনটি ভোলা একটু চাপের ৷ প্রতি বছর কুমার বাহাদুর ঘোর চ...