আমাদের সকলেরই আশেপাশে সমাজ নামক যে এক অদ্ভুত পরিধি আছে, তাতে ভুলভাল লোকের সংখ্যাটাই বোধয় বেশি। এই লোকজনরা তাদের নাকটিকে নিজেদের আয়ত্তে কখনোই রাখতে পারেন না। নিজেদের বাবা- মা অব্দি যে বিষয় কথা বলেন না, এই এনারা নিজেদের থেমে থাকার গন্ডী ভুলে,অবলীলায় নিজেদের দীর্ঘ প্রসারিত নাকটিকে সযত্নে ঢুকিয়ে দেন সেই সব বিষয়ে।
এরা তো অসহ্য । তবে আমি নিজে আরো অসহ্য। হ্যাঁ, একদমই তাই ,অসহ্য অসহ্য এবং অসহ্য। কোনদিনই এই ভুলভাল লোকেদের ভুলভাল কথার বা প্রশ্নের একটা যোগ্য জবাব আমি দিয়ে উঠতে পারি না। কখনোই না, কোনোভাবেই না। মাথার মধ্যে একটা কড়মড়ে জবাব কীট কীট করে কিন্তু গলায় এসে তিনি রাস্তা হারিয়ে পুনরায় মস্তিষ্কে ফিরে যান। ফলত ভুলভাল কথার বিরক্তি, ভুলে ভরা বাণী যিনি শোনাচ্ছেন তাকে সহ্য করার বিরক্তি এবং সেই কথার একটি পাকাপোক্ত উত্তর না দিতে পারার বিরক্তিতে মাথা চিরবিড়িয়ে যায়। শুধু তাই নয়, আমি চোখে মুখে বা অভিব্যক্তিতেও সেই বিরক্তিটা প্রকাশ করে উঠতে পারি না। উল্টে একটা স্মিত হাসি হেসে তাদের পাস কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। এবং তারা এই হাসির সদথর্ক মানে ধরে ভবিষ্যতে আবারও ভুলভাল কথা বলার সাহসটি পেয়ে যান।
বিয়ের কিছুদিন পরই, কোনো মিয়াঁ-বিবির কোলে যদি একখান ছানা এবং পোনা দেখতে না পাওয়া যায়, অবধারিত ভাবে এই বৃহৎ নাসিকাযুক্ত মানুষজনের নাক আরো লম্বা হয়ে সেই দম্পতির শোবারঘরে ঢুকে পড়ে। খুব স্বাভাবিকভাবেই ব্যক্তিগত শব্দের মাথা খেয়ে প্রশ্নবাণ চালাতে থাকেন , " কি গো তোমার বাচ্চা কবে হবে?" বা " কবে ছোট্ট মামন /শ্রীরূপা বা টুকুন/অতনু কে দেখবো?" বা "কবে আমাদের নাতি নাতনি হবে?"
কুমার বাহাদুর বলে এরম প্রশ্ন করলে তুমি বলতে পারো না, যে এটা আমাদের একান্ত ব্যাক্তিগত ব্যাপার, এটা নিয়ে প্রশ্ন করার কোনো অধিকার নেই আপনার। বহুবার ভেবেছে এই জবাবখান দি। কিন্তু ওই, আমার উত্তরগুলো কণ্ঠনালীর পথই খুঁজে পায় না যে।
কুমার বাহাদুর আমায় প্রশিক্ষণ দিয়েই চলে কি ভাবে এই ধরণের চরিত্রদের সঠিক উত্তর দিতে হয়। আমিও একদম বাধ্য ছাত্রীর মতন সব টা শুনি, বুঝি কিন্ত বলে উঠতে পারি না। নিজেও নিজেকে বলি খুব কাছের মানুষদের ক্ষেত্রে না হলেও বাইরের লোকেরা যারা নিজেদের পরিধি বোঝে না তাদের সেটা বুঝিয়ে দেওয়াটা খুব দরকার। কিন্তু পেরে উঠি না। কেন যে পারি না কে জানে।
গতকাল মা র কাছে যাচ্ছি, অটো থেকে নেমে হাঁটছি, এক মুখচেনা জেঠিমার সঙ্গে দেখা। আমায় দেখেই একগাল হেসে প্রশ্ন করলেন,
"কবে এলে ??"
"এই তো এখনই।"
"ওওও, বেশি আসা হয়না না? দেখতে পাইনা তো? আর মেয়েদের জীবন, একবার বিয়ে হয়ে গেলে কি আগের মতন থাকে!"
এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, তবু তবু তবু আমি তো আমি, দিয়ে চললাম উত্তর। "না না আসি তো, প্রতি সপ্তাহেই মার কাছে ঘুরে যাই।"
"আচ্ছা আচ্ছা, ভালো ভালো, তা জামাই আসেনি?"
"না, ওর কলেজ আছে।"
"আচ্ছা।" - এই বলে উনি নিজের রাস্তায় আমি নিজের রাস্তায় এগিয়ে যাচ্ছি, আবার পেছন থেকে প্রশ্নঃ
"আচ্ছা তোমার কবে যেন বিয়ে হলো??"
এবার বুঝে গেছি কি প্রশ্ন আসতে চলছে। নাঃ আজ একটা যোগ্য জবাব আমি দেবইঃ "২০১৪"
এবার বুঝে গেছি কি প্রশ্ন আসতে চলছে। নাঃ আজ একটা যোগ্য জবাব আমি দেবইঃ "২০১৪"
"ও বাবা! ২০১৪-১৫-১৬-১৭-১৮, অনেএএএক দিন হলো তো!!! এবার তো আমাদের একটা নাতি নাতনি চাই নাকি?"
আমার দুই বাড়ির দুই মা এবং বাবা এইভাবে জীবনে কখন প্রশ্ন করনি। তাদের কোনই মাথাব্যথা নেই তাদের নাতি নাতনি নিয়ে। আর ইনি কোথাকার কে , আমার বাচ্চার ঠাকুমা হওয়ার জন্য আকুল হয়ে উঠেছেন। আজ আমি কুমারের শেখানো জবাবটা দেবই দেব। বললুমঃ "জেঠিমা প্রশ্নটা একটু ব্যক্তিগত হয়ে গেল না!"
আহ এই তো এতদিনে একটা জমাটি জবাব দিয়েছি। অসম্ভব গর্ব বোধ করছিলাম নিজের স্মার্ট উত্তরের জন্য। সেই মুহূর্তেই আমার সব এক্সপেক্টেশন ভেঙে ভদ্রমহিলা বললেনঃ "ওসব ব্যক্তিগত ট্যক্তিগত তো ঠিক আছে, কিন্তু আমাদের তো চাই তাড়াতাড়ি।"
এনাদের ডিকশনারিতে "ব্যক্তিগত" শব্দটা নেই। ফলত এর অর্থ, পরিধি কিছু সম্পর্কেই অবগত নয়। তবে আজ যখন বলতে শুরু করেছি, চুপ আমি থাকবো না, হাসতে হাসতে বললুমঃ
"কিছু তো করার নেই জেঠিমা আপনার চাই, কিন্তু আমার যে চাই না।"
এবার ওনার মাথায় বাজ পড়লো, একদম সিরিয়ালের অদ্ভুত সাজের ভদ্রমহিলাদের মতন দুগালে, সত্যিই দুগালে হাত দিয়ে বললেনঃ
"ওমা গো! একি কথা!! হা ভগবান !!! মেয়েমানুষের মুখে এমন কথা, হা ভগবান!!!!"
"আসছি, জেঠিমা। সাবধানে যান যেখানে যাচ্ছেন।"
অদ্ভুত একটা ভালোলাগায় মনটা ভরে গেল। সাধারণত এরম কোন মানুষের পাল্লায় যেদিন পরি মহা বিরক্তিতে সারাদিনটা কাটে। মাথায় বিজবিজ করা উত্তরগুলো বলে উঠতে না পারার বিরক্তিতে। এই প্রথম বড্ড ভালো লাগলো। কি যে আরাম এরম জবাব দানে জীবনে এই প্রথম বুঝলাম। বাড়ী ফিরে কুমারকে সব বলতে সেও নিজের প্রশিক্ষণের সফলতায় খুশি হয়ে, হাফ ছেড়ে বলল, "যাক!! শেষ মেশ...."
Comments
Post a Comment