Skip to main content

দীঘার ডায়েরি

উঠলো বাই তো চট করে দীঘায় পালাই। রোজকার জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে, বাঙালির ডাল-ভাত বেড়ানোর জায়গা মানে দীঘায় চললুম 2 দিনের জন্য। বেড়াতে যাওয়ার সবকিছুই বড্ড ভালো। যাবো যাবো আনন্দ, জিনিস পত্র নেয়ার লিস্টি বানানো, গোছ-গাছ থেকে শুরু করে সমুদ্দুরের বা পাহাড়ের হাওয়া খাওয়া। তবে সবচেয়ে মিষ্টি ব্যাপার হলো, প্রতি বার বেড়োনোর আগে বাবা - মার সামনাসামনি এবং আরেক মা ওভার ফোনে সতর্কবার্তা। আমরা বেড়াতে গেলেই আমাদের বাড়ির সবাই এক্সপার্ট হয়ে যায়, কেউ বা আবহাওয়া বিশারদ হয়ে যান কেউ বা ভূতত্ববিদ। এই যেমন আজ বাবা বলল, "একদম জলে নামবি না, কদিন ঝড় বৃষ্টি হবে বলছে", মা বলল, " নানা ঝড় বৃষ্টি হোক বা না হোক জলে নামার কোনো দরকারই নেই", আরেক মা ফোনে বলল, "সমুদ্রের অবস্থা খুব খারাপ নামিস না যেন।" এই একইরকম সতর্কবার্তা চলতেই থাকে পাহাড়,সমুদ্র বা জঙ্গল যেখানেই যাই । আমরা নিজেদের যতই দিগ্গজ ভাবি না কেন বাবা-মা দের কাছে সেই চার-পাঁচ কি তারও কমেই আটকে আছি। আমরাও হাসতে হাসতে নিজেরদের মধ্যে চোখাচুখি সেরে, ঘাড় নেড়ে ভালো বাধ্য বাচ্চাদের মতো তাদের আস্বস্ত করে দি। প্রতিবার আসছি মা,আসছি বাবা বলার পরই যখন সতর্কবার্তা গুলো আবার মনে করিয়ে, পৌঁছেই ফোন করবি, সাবধানে যাবি শুনে বেড়োই মন টা ভীষণ পরিতৃপ্তিতে ভরে মিষ্টি হয়ে গিয়ে বেড়ানোর আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে যায়।



এক টুকরো দীঘা

নিউ দীঘার বীচে পৌঁছে দেখলাম কয়েকশ (বেশি তো কম নয়) লোকের ভীড়। দূর থেকেই দেখে বোঝা যাচ্ছিল জলের অবস্থা বেশ খারাপ। জলে পা ডোবাতেইই পর পর কালো জলের ঢেউ এসে জানান দিয়ে গেল নিজেদের দুর্গতির কথা । একে এত লোক, তারপর এরম কালো জল মেজাজটাই বিগড়ে গেল। যে আমি জলে পা ডুবিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে ভালোবাসি, ৫ মিনিটেই জল থেকে উঠে, ডাবের জল খেতে খেতে মাথা ঠান্ডার প্রচেষ্টা শুরু করলাম। । ডাব বিক্রি করছিলেন যে ভদ্রলোক তিনি বললেন, " আরে দিদি রাত তিনটে হোক আর দুপুর তিনটে, লোক সারাক্ষণ জলে ডুবে রয়েছে, জল নোংরা না হয়ে উপায় আছে।"

দুটো দিনের জন্য একটু প্রাণ খুলে নিঃস্বাস নিতে গেছি, সপ্তাহান্তে নয় সোমবারে পৌঁছেছি ,তাতেও এই অবস্থা। অসহায় ভাবে কুমার বাহাদুরের দিকে তাকিয়ে বললাম, " কি ভীড়!!! ভাল্লাগছে না, একটু ফাঁকা জায়গা খোঁজো না!!!" তিনি তো আরেক, আমার মাথা গরম দেখলে সেটাকে আরেকটু গরম করে ,তাতে সসপ্যান বসিয়ে চা বানিয়ে খেয়ে নিতে পারলে বাঁচে। জ্ঞানসুলভ বাণী শুনিয়ে বললেন, "তুমি তো এই ভীড়েরই অংশ,তাই নয় কি??? আর শোনো দীঘায় ফাঁকা জায়গা খোঁজা আর খরের গাদায় ছুঁচ খোঁজা একই ব্যাপার,বুঝলে।"
বুঝলুম যা করার আমাকেই করতে হবে। কোনোভাবেই বহুদিন বাদে পাওয়া আমাদের একটু ফুরসতের সময়কে এত্ত মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যেতে দেব না। বললুম ,আমি একটা ফাঁকা জায়গা খুঁজেই ছাড়বো, চলো। দুজনে মিলে সমুদ্রের পারের বাঁধানো রাস্তা দিয়ে হাঁটা লাগলুম ওল্ড দীঘা যাওয়ার উল্টোদিকে মানে উদয়পুরের দিকে।

১৫-২০ মিনিট হাঁটার পর শুধু ফাঁকা জায়গা নয়, খুঁজে পেলাম সেই ছোটবেলার দীঘাকে। বালিয়াড়ি,ঝাউবন আর অঢেল শান্তি। যতদূর অব্দি চোখ যাচ্ছে কোথাও কেউ নেই। দূরে একটা অদ্ভুত অস্বছ কুয়াশার চাদর সবকিছু আবছা করে রেখেছে। সামনে হাত পা ছড়িয়ে সমুদ্দুর গর্জন করছে আর সেই সমুদ্দুরের অবাধ্য হাওয়ায় পেছনের ঝাউবন আর বালিয়াড়ির আলুথালু অবস্থা। ঝাউবনের ভেতরে চোখ পড়তে দেখি, সেই রূপকথার গল্পের মতন সবুজ বনের ভেতর সাদা-বাদামি দু তিনটে ঘোড়া ঘোরা-ঘুরি করছে। কাছে যেতে বুঝলুম বীচে যে ঘোড়াগুলোকে অদ্ভুত সাজিয়ে সওয়ারি খোঁজে সেগুলোর দু একটা বাঁধা আছে, নিশ্চিন্তে ঘাস খাচ্ছে তারা। ছোট থেকে মা শিখিয়েছে কারো খাওয়ার সময় তার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে নেই। তাই ওনাদের বিব্রত না করে ভাবলুম একটু বালিয়াড়ি ওপরে চড়া যাক। গাঢ় নীল হাওয়াই চটি, লং স্কার্ট পুরো বালিতে বালিতে মাখামাখি হয়ে রং বদল করে ফেলল। বালিয়াড়িতে চড়া আর নামার কসরত সেরে গিয়ে বসলাম সমুদ্রের ধারে। কোথাও কেউ নেই দেখে বাঁধানো বসার জায়গায় খানিক গড়াগড়ি খেয়ে, শুয়ে শুয়েই সমুদ্দুরের দাপাদাপি দেখে অনেকদিনের পুরোনো একটা স্বপ্ন সার্থক করে ফেললুম। ছোট থেকে সমুদ্র ভালোলাগে, ভাবতাম ঠিক আমার ঘরের সামনেই একটা সমুদ্র থাকতো, বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঢেউয়ের দাপাদাপি দেখতুম। সেই স্বাধের স্বাদ চেখে নিলুম। চোখের সামনে সাদাফেনা এসে ঝাপ্টে পড়ছে। ঝাপ্টা জলদানা গুলো দলবেঁধে হাওয়ায় মিশে যাচ্ছে। অগুন্তি ঢেউ আসছে, ধাক্কা খেয়ে রেগে মেগে ফিরে যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে পূর্ণ উদ্যমে। কত্ততা সময় যে কেটে গেল, বুঝতেই পারলাম না। রাস্তার আলোগুলো জ্বলে উঠতে মনে হলো, "এবার ফিরতে হবে।"
খুঁজলে ভগবান পাওয়া যায় কিনা জানিনা তবে নিউ দীঘার জনসমুদ্রেও নিজেদের মতন সময় কাটানোর জন্য যে এমন "এক টুকরো দীঘা" পাওয়া যায়, সে ব্যাপারে নিশ্চিত।

বিচিত্রপুরের চিত্রপট

থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোর জীবনকে একপাশে রেখে গিয়ে পৌঁছলাম দীঘায়। দীঘায় যাওয়ার মূল কারণ সেখান থেকেই বিচিত্রপুর যাবো। নাহলে হয়তো মন্দারমনি বা তাজপুর যেতাম। বিকেলে সী বীচ থেকে ফেরার সময় একটা গাড়ির সাথে কথা বললাম, সে বলল বিচিত্রপুর আর ভূষণেশ্বর মন্দির একসাথে একটা প্যাকেজ ১৪০০ টাকা লাগবে। মন্দিরে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না, তাই ওটাকে বাদ দিয়ে ১২০০ টাকায় রাজী হলো বিচিত্রপুর যেতে।
পরের দিন সকাল বেলায় ৬ টায় বেড়িয়ে পড়লাম বিচিত্রপুর পাড়ি দিতে। রাস্তায় যেতে যেতে আমাদের ড্রাইভার দাদা বলছিলেন যে অন্য যে কোনো স্পটে দিনের যেকোনো সময় যাওয়া যায়, কিন্তু এই বিচিত্রপুরে যদি ঠিক সময়ে যাওয়ার না হয় কোনো লাভ নেই। ঠিক যখন জোয়ারটা আসে তখন যেতে হবে। জোয়ার আসার সময় নাকি পূর্ণিমা অমাবস্যায় আলাদা আলাদা হয়। তাই যদি এই জায়গার প্রকৃতিকে পুরোপুরি উপলব্ধি করতে হলে অবশ্যই সকাল ৭-৮ টার মধ্যে পৌঁছতে হবে।

আমরা পৌঁছে গেলাম তখন পৌনে ৭ টা। যেখানে পৌঁছলাম সেখান থেকে নৌকাবিহার মানে বোটিংয়ের টিকিট কাটতে হবে। এই নৌকাই বিচিত্রপুরের নেচার ক্যাম্পে নিয়ে যাবে আমাদের।নৌকা রিজার্ভ করতে হয়। ৬ জনের নৌকা ১০০০ টাকা এবং ৮ জনের ১২০০ টাকা। আমরা দুজন ছিলাম, চাইলে অপেক্ষা করে অন্য কোনো ছোট গ্রূপের সাথে শেয়ার করা যেতে পারতো। কিন্তু তখন কোনো ছোট গ্রূপ এসে পৌঁছয়নি। তাই আমরা দুজনেই একটা নৌকো ভাড়া করে নিলাম।
টিকিট কেটে দুকাপ চা খেয়ে, লাল কাঁকর বিছানো সরু রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকলুম নৌকাগুলো যেখান থেকে ছাড়বে সেদিকের উদ্দেশ্যে। অদ্ভুত সুন্দর জায়গা, রাস্তার দুদিকে জোয়ারের জল ঢুকে এসেছে, সবুজ সবুজ গাছগুলো পেট অব্দি ডুবে রয়েছে। দূর থেকে দেখলুম একটা লাল রঙের নৌকা দাঁড়িয়ে আছে, পা চালিয়ে গিয়ে উঠে বসলাম।

নৌকাটা যেখানে লাগানো ছিল, সেটা একটা সুবর্ণরেখা নদীর একটা খাঁড়ি।সেই খাঁড়ি বেয়ে নৌকা গিয়ে উঠলো নদী তে। নৌকা চলেছে নদীর মাঝখান দিয়ে, জোয়ারে সমুদ্রেরজল ঢুকে এক্কেবারে টইটুম্বুর নদী তখন। দুপাশের সবুজ সবুজ গাছগুলো কোনটা গলা অব্দি আবার কোনটা পেট অব্দি জলে ডুবে রয়েছে। কিছুটা এগোতেই দেখি সাদা রঙের এক অপূর্ব পাখি, অনেকটা সারসের মতন দেখতে। মাঝি দাদা বললেন ওগুলো নাকি সমুদ্রের পাখি। কেউ কেউ দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে কেউ আবার একা একা। জোয়ারের জলে পরিপূর্ণ ছাই রঙের নদীর দুপাশে যেখানে জল অল্প গভীর চোখে শান্তি দেয়া সবুজ গাছ আর তার ডালে বা আসে পাশে ঘুরে বেড়ানো ধবধবে সাদা পাখির দল। মনে হচ্ছিলো এভাবেই নৌকাবিহার চলে যেতেই থাকুক যেতেই থাকুক ...তখনও জানতাম না কি অপেক্ষা করে আছে।

অনেকটা যাওয়ার পর, নৌকো দেখি একটা দ্বীপে গিয়ে আসতে আসতে থেমে গেল। এতোক্ষন ভাবছিলাম বুঝি এইভাবে নৌকোয় ঘুরে ঘুরেই সময়টা কাটবে। হঠাৎ এই দ্বীপে গিয়ে নামার ব্যাপারটা সামনে আসতেই আনন্দে আর উত্তেজনায় আমি প্রায় একঝাপে নৌকো থেকে নেমে পড়লুম। ছোট্ট একটা দ্বীপ। ছোট থেকে অনেক সমুদ্র দেখেছি, সমুদ্র তটও অনেক দেখেছি কিন্ত এরম অদ্ভুত সুন্দর সমুদ্রতটে জীবনে এই প্রথম। সবুজ গাছে এসে সমুদ্রের ছোট ছোট ঢেউ আছড়ে পড়ছে। গাছ গুলোও অদ্ভুত। কোনটা শ্বাসমূল বের করে দাঁড়িয়ে আছে, কোনোটার কান্ড অদ্ভুত ভাবে বেঁকে গেছে, কোনটা সবুজ পাতায় ভরে কোনটায় আবার একটাও পাতা নেই। গাছের ডালে বসে রয়েছি আর পায়ে এসে ঠেকছে সমুদ্রের জল, এটা যে কি বিস্ময়কর অভূতপূর্ব একটা অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। জুতোটাকে একটু দূরে বালির ওপর রেখে, সাবধানে আসতে আসতে ( পা কেটে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে শ্বাসমূল বা গাছের শক্ত কোনো অংশে) খালি পায়ে পাড় দিয়ে, ছপাত ছপাত করতে করে দুজনে অনেকটা এগিয়ে এসেছি, হঠাৎ দেখি ড্রাইভার দাদা ডাকছে (উনিও এসেছিলেন আমাদের সাথে)। দ্বীপের ওপর দিকেটায় বেশ কিছু লাল কাঁকড়া এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের স্বাগত জানাতে। উনিই বলছিলেন এখন জোয়ারের জলের বালি ঠান্ডা হয়ে গেছে তাই সব গর্তে ঢুকে আছে নইলে সদলবলে এরা বালির ওপরে ছেয়ে থাকে। কাছে একটু এগোতেই যেকজন বাইরে এসেছিলো কুরকুড়িয়ে গর্ত-বাড়িতে ঢুকে গেলো। আমরাও আবার জলে ফিরে এলাম। এতক্ষণ প্রবল উত্তেজনায় যেগুলোকে সমুদ্রের ঢেউ ভাবছিলাম জানতে পারলাম সেটা আসলে সমুদ্র এবং সুবর্ণরেখা নদীর মিলিত ঢেউ। অর্থাৎ এটা হলো সুবর্ণরেখা নদীর মোহনা। দূরে সমুদ্র দেখা যাচ্ছিল।

প্রকৃতির এরম রূপ দেখলে সবাই পাগল হয়ে যায়। আমি জলের মধ্যে একবার গাছের ডালে গিয়ে বসি তো একবার বাঁশ দিয়ে তৈরি করা বসার জায়গায়। শান্ত শিষ্ট কুমার বহাদুরও দেখি ছবি তুলতে তুলতে একটা নেড়া গাছের মগডালে উঠে বসে আমায় হাঁক পারছে একটা ছবি তুলে দেয়ার জন্য। আমাদের ড্রাইভার দাদাও গিয়ে শুয়ে পড়লেন একটা নাইলনের দোলনায়। মনে হচ্ছিল ওখানেই থেকে যাই। আর ফিরবো না এই রোজকার হিসেবী জীবনে। কিন্তু সেটি তো হওয়ায় নয়। প্রায় ঘন্টাখানেক কাটানোর পরই মাঝি দাদার ডাক এলো, "ফিরতে হবে তো!"
ফিরে এলাম, তবে মনটা আটকে রইলো ওখানেই। বিচিত্রপুরের চিত্রপটের পুরোটাই মনের ক্যামেরায় এবং কিছুটা ফোনের ক্যামেরার বন্দী করে নিয়ে এলাম শহুরে কেজো জীবনের রসদ করে।

বি.দ্র: বিচিত্রপুরে থাকার একটা ব্যবস্থা আছে শুনেছি। কিন্তু আমার মনে হয় দীঘা থেকে যাওয়াটাই ভালো বা তাজপুর, তালসারি থেকেও যাওয়া যেতে পারে। চন্দনেস্বর মন্দিরের পাশ দিয়ে বিচিত্রপুর যাওয়ার রাস্তাটা পরে। বিচিত্রপুরে এই নেচার ক্যাম্প ছাড়া আর কিছু বিশেষ তেমন দেখার নেই বলেই শুনলাম। তাই একবার নেচার ক্যাম্প ঘুরে এলে সারাদিন সেভাবে সময় কাটানোর কোনো জায়গা নেই। দীঘা তো সবাই যাই, এবারে দীঘা গেলে বা তাজপুর ,তালসারি গেলে টুক করে বিচিত্রপুর ঘুরে আসার আর্জি রইলো।



ঝিনুক টিলা

সমুদ্রের পাড়ে হাঁটতে হাঁটতে এখন আর সেই আগের মতন ঝিনুক খুঁজেই পাই না। বিচিত্রপুর থেকে ফেরার সময় ড্রাইভার দাদা নিয়ে গিয়ে নামালেন একটা জায়গায়। নামটা ঠিক মনে নেই, একটা মাছের ভেরি, না না রকম মাছ নিয়ে দর হাঁকাহাঁকি চলছে। সেই ভেরি থেকে একটু এগিয়ে যেতেই একটা জেটি। ছড়ানো ছেটানো মাছ ধরার জাল, আর নাইলনের বস্তায় কি যেন বাঁধা। কাছে গিয়ে দেখি বস্তা বন্দী হয়ে পড়ে আছে প্রচুর ঝিনুক। জেটির বাইরেও প্রচুর ঝিনুকের ঢিবি রোদ পোয়াচ্ছে শুকনো হবার জন্য। দেখে মনটা একটু খারাপই হয়ে গেলো। সমুদ্রের মধ্যে পায়ে পায়ে ঝিনুক খুঁজে পাওয়ার যে আনন্দ ছিল, সেটা হারিয়ে গেল। ঝিনুকও এখন পণ্য, অবহেলায় পাড়ে পরে থাকার সময় নেই তার।


উদয়পুরের তটকথা

উদয়পুরের বীচে পৌঁছলাম যখন আকাশ তখন কালো গোঁফে তা দিতে দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে সদলবলে আছড়ে পড়ার। বীচের চাকা লাগানো ফুচকা-কুলফি-ঝালমুড়ি দোকান গুলো রেস লাগাচ্ছে ঢালু চড়ে রাস্তায় ওঠার জন্য। আমরা পাস কাটিয়ে ঢালাও চওড়া তট পেরিয়ে পৌঁছলাম সমুদ্রের কাছে। একটা দুটো তিনটে ছোট ছোট ঢেউ এসে পা ছুঁয়ে যেন বলতে লাগলো, বৃষ্টি আসলে আসুক, সমুদ্রের বৃষ্টি মন ভালো করে দেয়। জলটা একদম পরিষ্কার টল টল করছে। তটে এসে আছড়ে পরে কিসের টানে যেন আবার ফিরে যাচ্ছে। ফেলে যাওয়া জলের সরটা গায়ে মেখে উদয়পুরের বালিরাশি তখন আরশি হয়ে গেছে। ঘনঘোর আকাশের রং, মানুষের দেহের আকার সবকিছুর প্রতিচ্ছবি নিজের মধ্যে ছাপিয়ে নিয়েছে। 


উদয়পুরে পৌঁছেছিলাম ভটভটি ভ্যানে চেপে। জলের মধ্যে এদিক ওদিক করছি। হঠাৎ কুমার বাহাদুর বলল, ওই দেখো অনেকটা দুরে সেই ওয়াচ টাওয়ার টা আর বেশ কিছু মানুষের ঢল, তার মানে দীঘাটা খুব দূরে নয়, আসতে আসতে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই। যেমন ভাবা তেমন কাজ। দুজনে সমুদ্রের পারে যেখানে ঢেউ গুলো এসে মেশে, কোথাও গোড়ালি ডুবো জল কোথাও বা হাঁটু অব্দি, হাত দুটো শক্ত করে ধরে ছপাত ছপাত করতে করতে পাড়ি লাগালাম দীঘার দিকে। ঘনকালো আকাশটাও মাথার ওপর সূয্যিমামাকে আড়াল করে ছাওয়া করে দিলো, হালকা ঝোড়ো হাওয়া, খালি পায়ে ঠান্ডা ঢেউ এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে, হাতে হাত চিরসখার..... আর কি সত্যি কিছু চাওয়ার থাকতে পারে জীবনে????


Comments

Popular posts from this blog

একটা চেয়ার আর কিছু গল্পকথা

দোলনা চাপতে কার না ভালো লাগে....আমার তো ছোটবেলা থেকেই দোলনার প্রতি অমোঘ আকর্ষণ...কিন্তু মুশকিলটা ছিল মানুষটা আমি ছোট থেকেই বেশ মোটাসোটা, ফলত দোলনা চাপলেই আশপাশ থেকে কেউ না কেউ বলে উঠত "এইরে দোলনাটা ভেঙে পড়ল বলে" বা "দোলনাটা হাতিদের চড়ার জন্য নয়" আরও কত কি...খুব কষ্ট হত.... কষ্টে ঝপাং ঝাপ দিয়ে নেমে পড়তাম। তখন কলেজে পড়ি...আমার সবথেকে ভালো বন্ধুর বাড়ির উল্টো দিকে একটা পার্ক ছিল...প্রথম দিনই ওদের বাড়ি যাওয়ার সময় লক্ষ্য করেছিলাম ওই পার্কটিতে দুটো দোলনা আছে এবং যার সামনে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল "২-৫ বছরের শিশুদের জন্য" ... তাতে কি !!! প্রথম ভালোবাসার টানে মানুষ সব অন্যায় করতে পারে ... যেদিন ওদের বাড়ীতে রাত্তিরে থাকতাম ... ৬টার পর পার্ক বন্ধ হয়ে গেলে ... অন্ধকারে ছোট পাঁচিল টপকে আমরা পার্কে ঢুকতাম ... আর মনের আনন্দে আমি দোল খেতাম ... ভাবলাম কি ভালো ... কেউ কিছু বলার নেই বারণ করার নেই ... কোন সময় সীমা নেই যতখুশি যতক্ষণ খুশি দোল খাও। এইভাবে ২-৩ বার সাধ পুরণের পরই ... একদিন পার্কের পাশের বাড়ী থেকে চিৎকার শোনা গেল "কে?? কেএএএ? কারা পার্কে?? প্রায়ই পার্ক বন্ধ হব

টিকিটপুরাণ

পুজোয় বেড়াতে যাওয়ার টিকিট কাটা আর টানটান রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস পড়া একই ব্যাপার। প্রতি মুহূর্তের উত্তেজনা, এই ফসকে গেল গেল হৃদকম্পে রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার জোগাড় হয়। আমাদের আজ টিকিট কাটার পর্ব ছিল। নিজেরাই কাটি। দায়িত্ব থাকে কুমার বাহাদুরের ওপর। কাল রাত্তির থেকে যুদ্ধ চলছে। প্রতিবার বেড়াতে যাওয়ার আগে আমাদের whatsapp এ একটা গ্রূপ খুলে ফেলার দায়িত্বে থাকি আমি। যাওয়ার ঠিকানা বদলাতে থাকে , সঙ্গে গ্রূপের নামও। কাল রাত্তির থেকেই আমরা খুব উত্তেজিত, কারণ irctc র সাইট খুলে দেখা গেছে ৪ মাস আগে যে তারিখের টিকিট বুক করা যাচ্ছে, সেটা সেদিনই ওয়েটিং এ চলে যাচ্ছে। তাই একদম ঝপাঝপ কাজ সারতে হবে। নানা রকম আলোচনায় রাত্তির থেকে whtsapp এর গ্রূপ উত্তাল। বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মতামত, লক্ষ একটাই,কনফার্ম টিকিট চাই-ই চাই। সবার স্নায়ু টান টান কাল কি হবে, একেবারে ভারত-অস্ট্রেলিয়ার ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনাল খেলার মতন। রাতে শুয়েই পড়েছি হঠাৎ whtsapp গ্রূপে অংশুমানের মেসেজ রাত ১২ টার পর টিকিট কাটা যাবে মনে হয়। মেসেজ পড়া মাত্রই কুমার বাহাদুর ঝপ করে উঠে ল্যাপটপ খুলে বসল কিন্তু কোথায় কি !!! আবার অংশুমানের মেসেজ," না ১২ টা

মা

শীতকাল মানেই গরম গরম লেপে পা ঢুকিয়ে গল্পের বই পড়া। মার হাতের কড়াইশুটির কচুরী- আলুরদম আর ফুলকপি - নতুন আলু - টমেটো- মটরশুটি দিয়ে গরম গরম খিচুড়ি খেয়ে রসনাতৃপ্তি করা। ট্রাঙ্ক থেকে বের করা ন্যাপথলিনের গন্ধ মাখানো সোয়েটার,চাদর আর মার গা থেকে পন্ডস ক্রিম মাখানো মা মা গন্ধ। দু হপ্তা হয়ে গেল নানান ঝামেলায় মার কাছে যাওয়াই হচ্ছে না। আজ সকালে থেকেই বড্ড মা পাচ্ছে। ধুত্তোর চুলোয় যাক সব কাজ আজ মার কাছে যাবোই যাবো। ফোন লাগলাম মাকে, "আজ আমি আসছি।" গমগমে হাসি হাসি গলা বলে উঠলো, "কখন আসবি?? গরম জামাকাপড় কিছু বয়ে বয়ে আনিস না, আমি সব বের করে, রোদ খাইয়ে রেখেছি। স্কুল থেকে বেরোনোর সময় একটা ফোন করে দিস।" "আচ্ছা।" স্কুল থেকে ফিরে ঘরে ঢুকতেই দেখলাম রোদ থেকে তুলে নিয়ে আসা গরম গরম বালাপোস আমার দিকে আকুল নয়নে তাকিয়ে আছে। যা যা ঠান্ডায় পরার জামাকাপড় ছিল, সব লাইন দিয়ে সাজানো। কারণ মাতৃ মাপক যন্ত্র অনুসারে প্রচন্ড ঠান্ডা পড়েছে এবং ঠান্ডা আরো বাড়বে তাই, যাবতীয় গভীর ঠান্ডায় পড়া জামাকাপড় রা ট্রাঙ্ক থেকে বেরিয়ে সূর্যালোকে গা তাতিয়ে আমার অপেক্ষায় রয়েছে, কখন তাদের পরে আমি ধন্য করবো